অর্থনীতি

বিশ্ববাজারে সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায়, ডলার দুর্বলতা মূল কারণ

Advertisement

গতকাল মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম নতুন রেকর্ড গড়েছে। এদিন আউন্সপ্রতি সোনার দাম ৩,৫০৮.৫০ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন ডলারের দুর্বলতা, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের (Fed) সুদের হার কমানোর প্রত্যাশা এবং বিশ্ববাজারে বিনিয়োগকারীদের নিরাপদ সম্পদের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধিই মূলত এই উত্থানের প্রধান কারণ।

বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, চলতি বছরই প্রতি আউন্স সোনার দাম ৩,৬০০ ডলারের ওপরে যেতে পারে। এটি ২০২৫ সালের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে ধরা হচ্ছে।

মার্কিন ডলারের দুর্বলতা এবং ফেডের সুদহার

বিশ্ব অর্থনীতিতে মার্কিন ডলারের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে ডলারের মূল্য দেড় মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ফেডের সুদহার কমানোর সম্ভাবনা থাকায় বিনিয়োগকারীরা ডলারের বিকল্প হিসেবে সোনার দিকে ঝুঁকছেন।

ক্যাপিটাল ডটকমের বিশ্লেষক কাইল রড্ডা জানান, “দুর্বল অর্থনৈতিক সূচক এবং সুদের হার কমানোর সম্ভাবনা বিশ্ববাজারে সোনাসহ মূল্যবান ধাতুর চাহিদা বাড়াচ্ছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের স্বাধীনতা নিয়ে রাজনৈতিক চাপও বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন করছে।”

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফেড এবং এর চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলের সমালোচনা করেছেন বহুবার। তাঁর অভিযোগ, ফেড সুদহার যথাযথভাবে কমাচ্ছে না। সম্প্রতি, ফেডের ওয়াশিংটন সদর দপ্তরের ব্যয়বহুল সংস্কারকাজের কারণে তিনি আবারও সমালোচনা করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেন, “ফেড স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, যা থাকা উচিতও। তবে কিছু ক্ষেত্রে ফেডের সিদ্ধান্তে ভুল আছে। প্রেসিডেন্টের অধিকার রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রমে পর্যবেক্ষণ করার।”

সিএমই ফেডওয়াচ টুল অনুযায়ী, ব্যবসায়ীরা এখন ধরে নিচ্ছেন যে ১৭ সেপ্টেম্বর ফেড এক চতুর্থাংশ শতাংশ পয়েন্ট সুদহার কমাতে পারে, সম্ভাবনা প্রায় ৯০ শতাংশ।

সোনায় বিনিয়োগের আকর্ষণ

সোনা সুদের মতো নগদ রিটার্ন দেয় না, তবে সুদহার কম থাকলে এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ফেডের সুদহার হ্রাসের প্রত্যাশা এবং ডলারের দুর্বলতা মিলিয়ে বিনিয়োগকারীরা সোনায় আরও আগ্রহী হচ্ছেন।

বিশ্ববাজারে বর্তমানে সোনার চাহিদা ও দাম উভয়ই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বিনিয়োগকারীরা ক্রমশ সোনার দিকে ঝুঁকছেন, বিশেষ করে ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময়।

চলতি বছরের সোনার বাজারের প্রবণতা

২০২৫ সালের প্রথম আট মাসে সোনার দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্চ মাসে মার্কিন বাণিজ্য নীতি নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে সোনার প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেড়ে যায়। এ সময় প্রথমবারের মতো আউন্সপ্রতি দাম ৩,০০০ ডলার অতিক্রম করে।

কেসিএম ট্রেডের প্রধান বাজারবিশ্লেষক টিম ওয়াটারার জানান, “যদি ফেড সুদহার কয়েকবার কমায় এবং রাশিয়া–ইউক্রেন শান্তিচুক্তি অধরাই থাকে, তাহলে সোনার দাম আরও বৃদ্ধি পাবে। বছরের শেষ নাগাদ আউন্সপ্রতি সোনার দাম ৩,৬০০ ডলারের ওপরে পৌঁছাতে পারে।”

কেন সোনার দাম ওঠানামা করে?

সোনার দাম সরবরাহ এবং চাহিদার ওপর নির্ভর করে।

সরবরাহ:

সোনা বাজারে আসে দুইভাবে—নতুন খনি থেকে উত্তোলন এবং পুরোনো সোনা বিক্রি। প্রতি বছর খনি থেকে প্রায় একই পরিমাণ সোনা উত্তোলিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালে মহামারির পরও সোনা উত্তোলন প্রায় আগের বছরের সমান ছিল, ৩,৪৭৬ টন।

চাহিদা:

সোনার চাহিদা আসে মূলত দুটি উপায়ে—গয়না এবং বিনিয়োগ। চীন ও ভারত প্রধান গয়নার বাজার। আন্তর্জাতিক গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, মোট সরবরাহের প্রায় ৪৭ শতাংশ গয়নায় ব্যবহৃত হয়, যা প্রায় ২,০০০ টনের বেশি।

ভারতে এখনো বিয়ের মরসুম শুরু হয়নি। নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া মৌসুমে সোনার চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া, সোনার বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন ধরনের আর্থিক পণ্য রয়েছে। অনিশ্চয়তার সময় এসব পণ্যে বিনিয়োগ আরও বেড়ে যায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা

কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বিশ্ববাজারে সোনার দাম প্রভাবিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই প্রভাব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের ২০২৫ সালের সেন্ট্রাল ব্যাংক গোল্ড রিজার্ভ সার্ভে অনুযায়ী, ৪৩ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী বছর তাদের স্বর্ণভান্ডার বৃদ্ধি করতে আগ্রহী।

অন্যান্য জরিপে দেখা গেছে, ৯৫ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে যে তাদের কাছে আগামী ১২ মাসের জন্য পর্যাপ্ত সোনা মজুদ আছে। যুদ্ধ ও ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক দেশ ডলারের বিকল্প হিসেবে সোনায় বিনিয়োগ করছে।

রুপার বাজার

সোনার পাশাপাশি রুপার দামও ক্রমশ উত্থিত হচ্ছে। গতকাল আউন্সপ্রতি রুপার দাম ছিল ৪০.৬৪ ডলার। যদিও পূর্ববর্তী কিছু দিন রুপার দাম স্থিতিশীল ছিল, সেপ্টেম্বর ২০১১ সালের পর এটি সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সোনার দামের মতো রুপার দামেরও ওঠানামা বিনিয়োগকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বহন করে।

আন্তর্জাতিক ও ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপট

বিশ্ববাজারে সোনার চাহিদা ও দামের বৃদ্ধি একটি বৈশ্বিক প্রবণতা হিসেবে দেখা যাচ্ছে। ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা, বাণিজ্য নীতি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকাণ্ড এবং মুদ্রার ওঠানামার কারণে সোনার বাজার বিনিয়োগকারীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি আন্তর্জাতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায় এবং ফেডের সুদহার কমানো হয়, তাহলে সোনার দাম চলতি বছরের শেষ পর্যন্ত আরও বৃদ্ধি পাবে।

সংক্ষেপে:

  • সোনার আউন্সপ্রতি দাম ৩,৫০৮.৫০ ডলার, চলতি বছরের শুরু থেকে প্রায় ৩০% বৃদ্ধি।
  • মার্কিন ডলারের দুর্বলতা ও ফেডের সুদহার কমানোর প্রত্যাশা মূল চালিকা শক্তি।
  • কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বর্ণভাণ্ডারের বৃদ্ধি এবং নিরাপদ বিনিয়োগের চাহিদা দাম বৃদ্ধি করছে।
  • নভেম্বর থেকে ভারতের বিয়ের মৌসুম শুরু হলে গয়নার চাহিদা আরও বাড়বে।
  • রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ ও ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার চাহিদা বাড়িয়েছে।

সোনার বাজারে এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি বছরের শেষ নাগাদ আউন্সপ্রতি দাম ৩,৬০০ ডলারের ওপরে যেতে পারে।

MAH – 12625,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button