অর্থনীতি

বাজেট ২০২৫-২৬: দাম বাড়তে পারে যেসব পণ্য, ক্ষতিগ্রস্ত হবে কোন শ্রেণি

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সোমবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেছেন। বাজেট পেশের সঙ্গে সঙ্গেই কার্যকর হয় আমদানি শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) সংশ্লিষ্ট অনেক প্রস্তাব, যার ফলে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু পণ্যের দাম বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

নতুন বাজেটে বিভিন্ন পণ্যে শুল্ক ও কর বৃদ্ধির প্রস্তাব আসায় সাধারণ ভোক্তা, মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তাদের মাসিক ব্যয় পরিকল্পনায় বড় ধাক্কা খেতে পারে। নিচে আলোচনা করা হলো বাজেটে ঘোষিত সেইসব পণ্য ও খাত, যেগুলোর ওপর কর বাড়ানোয় বাজারে দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মুঠোফোন

দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন ও সংযোজন শিল্পে মূসক অব্যাহতির পরিধি কমানো হয়েছে। ভ্যাট ছাড় কিছুটা কমিয়ে শুধু মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, ফলে মোবাইল হ্যান্ডসেটের দাম বাড়তে পারে।


বাংলাদেশে স্মার্টফোন এখন শুধু বিলাস নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। শিক্ষার্থী, ফ্রিল্যান্সার, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা—সবার জন্য মোবাইল ফোন অপরিহার্য। দাম বাড়লে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

ওয়াশিং মেশিন, ব্লেন্ডার, রাইস কুকার ইত্যাদি

ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ব্লেন্ডার, প্রেসার কুকারসহ গৃহস্থালি যন্ত্রপাতির উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির সীমা কমিয়ে আনা হয়েছে।

প্রভাব:
শহরাঞ্চলে এসব যন্ত্রপাতি এখন অনেক ঘরের দৈনন্দিন ব্যবহার্য বস্তু। ভ্যাট বাড়ায় দাম বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো নতুন কেনাকাটায় পিছিয়ে যেতে পারে।

প্লাস্টিকের থালা-বাসন ও গৃহস্থালি সামগ্রী

প্লাস্টিক তৈজসপত্রে ভ্যাট ৭.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে, যা সরাসরি খুচরা বাজারে প্রভাব ফেলবে।

প্রভাব:
এই সিদ্ধান্ত গ্রামীণ ও নিম্নআয়ের মানুষকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে। কারণ তারা সাধারণত সস্তা প্লাস্টিকের বাসনপত্র ব্যবহার করে থাকেন।

তবে পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিকজাত পণ্যে ভ্যাট ছাড় অব্যাহত রাখা হয়েছে, যা পরিবেশগতভাবে ইতিবাচক হলেও এসব পণ্য এখনো ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় সহজলভ্য নয়।

এলপিজি সিলিন্ডার

এলপিজি সিলিন্ডারে স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি কমানো হয়েছে, যদিও মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এতে করে এলপিজি সিলিন্ডারের দাম বাড়তে পারে।

প্রভাব:
গ্রামীণ ও শহরতলির গৃহস্থালির রান্নার খরচ বাড়বে। পাশাপাশি অটো-রিকশা ও হালকা যানবাহনে ব্যবহৃত এলপিজির দামও বাড়লে পরিবহন খরচ বাড়তে পারে।

বিদেশি চকলেট

বিদেশি চকলেট আমদানিতে শুল্কায়ন মূল্য ইউনিটপ্রতি ৪ ডলার থেকে বাড়িয়ে ১০ ডলার করা হয়েছে।

প্রভাব:
এই খাতে দাম বাড়বে নিশ্চিতভাবেই। বিলাসপণ্য হিসেবে ধরা হলেও শহরের শিশু-কিশোরদের জন্য চকলেট অনেক সময় উপহার বা খাবারের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। দাম বাড়ায় এই অভ্যাস ব্যাহত হতে পারে।

লিপস্টিক, প্রসাধনী সামগ্রী

ঠোঁট, চোখ ও মুখে ব্যবহৃত প্রসাধনী পণ্যের শুল্কায়ন মূল্যও বাড়ানো হয়েছে।

প্রভাব:
সৌন্দর্যবর্ধন পণ্য নারীদের দৈনন্দিন ব্যবহারে আসে। দাম বাড়ায় কাজের নারীদের ব্যয় বেড়ে যাবে। স্থানীয় প্রসাধন ব্র্যান্ড কিছুটা লাভবান হলেও আমদানি পণ্যের বাজারে মন্দা দেখা দিতে পারে।

ব্লেড

দেশে ব্লেড উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট বাড়িয়ে ৫ শতাংশ থেকে ৭.৫ শতাংশ করা হয়েছে।

প্রভাব:
দাঁড়ি কাটার ব্লেডের দাম বাড়বে। প্রতিদিন ব্যবহারযোগ্য এ পণ্যে খরচ বাড়বে পুরুষদের। সেলুন খাতে খরচ বাড়ার ফলে সেবা গ্রহণের দামও বাড়তে পারে।

বাজারে সামগ্রিক প্রভাব

নতুন বাজেট ঘোষণার পরপরই খুচরা বাজারে কয়েকটি পণ্যের দাম বাড়ার আলামত দেখা যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, যেসব পণ্যে শুল্ক বা ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে, সেসব পণ্যের মজুত থাকা সত্ত্বেও তারা নতুন কর কাঠামো বিবেচনায় দাম সামঞ্জস্য করছেন।

অন্যদিকে, ভোক্তারা বলছেন, বাজেট ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই কোনো পুরোনো স্টকে থাকা পণ্যের দাম বাড়ানো অনৈতিক। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর যদি কঠোর নজরদারি না করে, তাহলে ভোক্তাদের ওপর অযৌক্তিক চাপ আসবে।

কারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশি?

  1. নিম্ন আয়ের পরিবার – যাদের রান্না, গৃহস্থালি সামগ্রী ও প্রাথমিক প্রসাধন পণ্যের ওপর নির্ভরতা বেশি।
  2. মধ্যবিত্ত শ্রেণি – যাদের আয় সীমিত, তবে জীবনযাত্রার মান টিকিয়ে রাখতে বৈদ্যুতিক পণ্য ও প্রসাধনী প্রয়োজন হয়।
  3. ছাত্র-ছাত্রী ও তরুণ সমাজ – মোবাইল ফোন, ব্লেন্ডার, চকলেটের মতো পণ্যে সরাসরি প্রভাব পড়বে।

কর কমানো হয়নি যেসব পণ্যে

দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ ভোক্তাপ্রয়োজনীয় পণ্যে কর বাড়লেও নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য বা কৃষিপণ্য সংক্রান্ত খাতে উল্লেখযোগ্য কর হ্রাস নেই। এটি স্বস্তির বিষয় হলেও সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি দমন করতে হলে আরও ব্যাপক ভিত্তিতে কর ছাড় দরকার ছিল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধিকে বড় হাতিয়ার হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এতে কিছু খাতে রাজস্ব বাড়লেও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়বে। বাজেট বাস্তবায়নের পথে সরকার যদি বাজার তদারকিতে সক্রিয় না থাকে, তবে মূল্যস্ফীতি ও ভোক্তা ভোগান্তি আরও বাড়তে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button