
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ আবারও নতুন বন্যার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। সাম্প্রতিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী তিন দিনের মধ্যে তিস্তা ও দুধকুমার নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এতে রংপুর, নীলফামারি, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সতর্কবার্তা
রবিবার (১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫) বাংলাদেশ বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (FFWC) এক বিশেষ সতর্কবার্তায় জানিয়েছে, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি সমতল ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এসব নদী বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। বিশেষ করে তিস্তা ও দুধকুমার নদীর পানি যদি একসাথে বৃদ্ধি পায়, তাহলে নদীসংলগ্ন গ্রামীণ জনপদে হঠাৎ বন্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
কেন্দ্রের তথ্যমতে, শুধু উত্তরাঞ্চল নয়, দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের কয়েকটি নদীতেও পানি বৃদ্ধি পাবে। সুরমা, কুশিয়ারা, সারিগোয়াইন, হালদা, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, মুহুরী ও ফেনী নদীর পানিও বাড়তে পারে এবং সতর্কসীমায় প্রবাহিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলার অনেক নিম্নাঞ্চল সাময়িকভাবে প্লাবিত হতে পারে।
কেন তিস্তা ও দুধকুমার নদীতে পানি বাড়ছে?
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারত ও ভুটানের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে টানা বৃষ্টিপাতের কারণে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা ও দুধকুমার নদীতে পানি হঠাৎ বেড়ে গেছে। উজান থেকে নামা অতিরিক্ত পানির কারণে নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
তিস্তা নদী প্রধানত হিমালয় থেকে নেমে এসেছে এবং এর পানির ওপর নির্ভর করে উত্তরাঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে যেখানে পানি স্বল্পতা থাকে, বর্ষায় সেখানে অতিরিক্ত পানির চাপ ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করে। একইভাবে দুধকুমার নদীও কুড়িগ্রাম জেলার জনপদে প্লাবন ঘটায়, যা কৃষক, দিনমজুর ও সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
নদীপাড়ের মানুষের শঙ্কা
কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার চরের বাসিন্দা রহিমা খাতুন বলেন—
“তিস্তার পানি বাড়লেই আমাদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। ঘরবাড়ি ভেসে যায়, ফসল ডুবে যায়। আমরা জানি না এবার কী হবে।”
নীলফামারীর ডোমার উপজেলার কৃষক শহীদুল ইসলাম জানান, ইতোমধ্যেই বৃষ্টির কারণে জমির ধান পানিতে ডুবে গেছে। যদি আরও পানি বাড়ে, তবে পুরো মৌসুমের ফসল নষ্ট হয়ে যাবে।
আগের অভিজ্ঞতা
প্রায় প্রতিবছরই তিস্তা নদী উত্তরাঞ্চলের মানুষের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, গত দশ বছরে অন্তত ছয়বার তিস্তা তার বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। ২০২০ সালের বন্যায় তিস্তার পানি ৫৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড ছুঁয়েছিল, যা লক্ষাধিক মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।
সরকারের প্রস্তুতি
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, নদীর পানি বৃদ্ধি মোকাবিলায় বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলা প্রশাসন পর্যাপ্ত পরিমাণে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের ব্যবস্থা নিয়েছে। পাশাপাশি পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীর বাঁধ ও স্লুইসগেটগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছে।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক বলেন,
“আমরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। প্রয়োজনে সেনাবাহিনী ও বিজিবিকেও মাঠে নামানো হবে। জনগণের নিরাপত্তা আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার।”
বিশেষজ্ঞ মতামত
জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, হঠাৎ বন্যার অন্যতম কারণ হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। অতিরিক্ত বর্ষণ ও অনিয়মিত মৌসুমি বৃষ্টি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে ব্যাহত করছে। এতে কখনও খরা, কখনও অতিবন্যা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. মাহবুবুর রহমান বলেন—
“তিস্তা ও দুধকুমার নদীর পানি নিয়ন্ত্রণে আঞ্চলিক সমঝোতা প্রয়োজন। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কার্যকর পানি বণ্টন চুক্তি ছাড়া বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল বারবার বন্যার ঝুঁকিতে পড়বে।”
ক্ষতির আশঙ্কা
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, নদীর পানি যদি বিপৎসীমা অতিক্রম করে, তবে হাজার হাজার হেক্টর জমির আমন ধান পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে। গবাদিপশু, বাড়িঘর ও স্থানীয় রাস্তাঘাটও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্থানীয়দের সরিয়ে নিতে ইতিমধ্যেই স্বেচ্ছাসেবক দল প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
স্থানীয়দের আহ্বান
নদীপাড়ের মানুষ সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তারা চান, স্থায়ী সমাধানের জন্য তিস্তা ব্যারাজ ও নদী খনন কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়ন করা হোক।
কুড়িগ্রামের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন—
“আমরা শুধু সাহায্য চাই না। আমরা চাই, এমন ব্যবস্থা হোক যাতে প্রতিবছর আমাদের ঘরবাড়ি ডুবে না যায়।”
বাংলাদেশে বন্যা নতুন কিছু নয়। তবে তিস্তা ও দুধকুমার নদীর পানি বৃদ্ধির খবর উত্তরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে নতুন করে শঙ্কা ছড়িয়েছে। সরকারের প্রস্তুতি থাকলেও, দীর্ঘমেয়াদি সমাধান ছাড়া প্রতিবছর এই নদীগুলোই দুঃখ বয়ে আনবে।
MAH – 12813 Signalbd.com