ইরানের অ্যারোস্পেস ফোর্সের নতুন প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মাজিদ মৌসাভি

ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বিমান হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) অ্যারোস্পেস ফোর্সের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলি হাজিজাদেহ নিহত হওয়ার পর দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি দ্রুত নতুন কমান্ডার নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন। সরকারি বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মাজিদ মৌসাভি ইরানের অ্যারোস্পেস ফোর্সের নতুন প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। এই নিয়োগের পাশাপাশি খামেনি নতুন প্রধানকে ইরানের মিসাইল ও ড্রোন সক্ষমতা আরও বৃদ্ধির নির্দেশ দিয়েছেন, যা দেশটির প্রতিরক্ষা কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা রোববার (১৫ জুন) এই খবর নিশ্চিত করেছে।
ইসরায়েলি হামলার প্রেক্ষাপট
গত শুক্রবার (১৩ জুন) ইসরায়েল ইরানে বড় পরিসরে বিমান হামলা চালায়, যা ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামে পরিচিত। এই হামলায় ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করা হয়। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর দাবি, প্রায় ২০০টি যুদ্ধবিমান এই অভিযানে অংশ নিয়েছিল এবং ইরানের ১০০টিরও বেশি স্থাপনায় আঘাত হানা হয়েছে। এর মধ্যে ছিল পারমাণবিক কেন্দ্র, ব্যালিস্টিক মিসাইল উৎক্ষেপণ কেন্দ্র, সামরিক ঘাঁটি এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এই হামলায় ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা, আইআরজিসি প্রধান মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি এবং খাতাম আল-আনবিয়া হেডকোয়ার্টারের কমান্ডার মেজর জেনারেল গোলাম আলী রাশিদসহ অন্তত ২০ জন জ্যেষ্ঠ কমান্ডার নিহত হয়েছেন। এছাড়া ছয়জন পারমাণবিক বিজ্ঞানীও এই হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এবং সংবাদ সংস্থাগুলো এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এই হামলাকে ‘ইহুদিবাদী সরকারের বর্বরতা’ আখ্যায়িত করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘কঠিন শাস্তি’র হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেন, “এই অপরাধের মাধ্যমে ইসরায়েল নিজেদের জন্য তীব্র পরিণতির পথ তৈরি করেছে, এবং তারা অবশ্যই তা ভোগ করবে।”
ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলি হামলার জবাবে ইরান শুক্রবার রাতে ইসরায়েলের দিকে শতাধিক ব্যালিস্টিক মিসাইল ও ড্রোন নিক্ষেপ করে। ইরানের সামরিক বাহিনী এই অভিযানের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস-৩’। ইরানি কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, এই হামলায় ইসরায়েলের সামরিক ও আকাশ প্রতিরক্ষা ক্যাম্পগুলোকে লক্ষ্য করা হয়েছে। তবে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) দাবি করেছে, তারা ইরানের ছোড়া সব ড্রোন ভূপাতিত করেছে। ইসরায়েলের হোম ফ্রন্ট কমান্ড জনগণকে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার নির্দেশনা প্রত্যাহার করলেও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
ইরানের পাল্টা হামলায় ইসরায়েলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে, তাদের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে, এবং হতাহতদের উদ্ধারে কাজ চলছে। এই পাল্টাপাল্টি হামলা মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের শঙ্কা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
নতুন নিয়োগ ও ইরানের কৌশল
ইসরায়েলি হামলায় শীর্ষ সামরিক নেতৃত্বের ক্ষয়ক্ষতির পর ইরান দ্রুত তার সামরিক কাঠামো পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি শনিবার (১৪ জুন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মাজিদ মৌসাভিকে অ্যারোস্পেস ফোর্সের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। এছাড়া, মেজর জেনারেল মোহাম্মদ পাকপুরকে আইআরজিসির নতুন কমান্ডার এবং মেজর জেনারেল আবদুর রহিম মুসাভিকে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই দ্রুত নিয়োগগুলো ইরানের সামরিক কাঠামোতে স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সৈয়দ মাজিদ মৌসাভির নিয়োগ ইরানের মিসাইল ও ড্রোন প্রযুক্তির উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন গতি সঞ্চার করবে। ইরান ইতোমধ্যে ভূগর্ভস্থ ক্ষেপণাস্ত্র সংরক্ষণাগার এবং ‘ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন সিটি’ উন্মোচনের মাধ্যমে তার সামরিক সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। আইআরজিসির মুখপাত্র জেনারেল আলী মোহাম্মদ নাঈনি জানিয়েছেন, ইরান নতুন মহড়া এবং যুদ্ধ প্রস্তুতির মাধ্যমে তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে।
ইরানের মিসাইল ও ড্রোন সক্ষমতা
ইরানের মিসাইল ও ড্রোন প্রযুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে তার সামরিক শক্তির অন্যতম ভিত্তি। দেশটির আজারাখশ এবং বাভার-৩৭৩ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং স্বল্প ও মধ্যপাল্লার অ্যান্টিব্যালিস্টিক অস্ত্র তাদের প্রতিরক্ষা কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এছাড়া, ইরানের ভূগর্ভস্থ ক্ষেপণাস্ত্র সংরক্ষণাগার এবং ড্রোন প্রযুক্তি তাদের আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষামূলক সক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করেছে। আইআরজিসি জানিয়েছে, তারা নতুন ধরনের বিশেষ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে, যা আঞ্চলিক শক্তিশালী দেশ হিসেবে ইরানের অবস্থানকে আরও মজবুত করবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েল-ইরান সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে এবং সংযমের আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের ওপর ‘সর্বোচ্চ চাপ’ নীতি অব্যাহত রাখার ইঙ্গিত দিয়েছেন, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করতে পারে। তবে, মার্কিন কর্মকর্তারা ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার আশা প্রকাশ করেছেন।
উপসংহার
ইরানের অ্যারোস্পেস ফোর্সের নতুন প্রধান হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মাজিদ মৌসাভির নিয়োগ এবং ইরানের মিসাইল ও ড্রোন সক্ষমতা বৃদ্ধির নির্দেশনা দেশটির প্রতিরক্ষা কৌশলের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার প্রকাশ করে। ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলা এবং ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের শঙ্কা বাড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইরানের নতুন সামরিক নেতৃত্ব কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এবং আঞ্চলিক ভারসাম্য বজায় রাখে, তা আগামী দিনগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে।