ফ্যাক্ট চেক

সাফারি পার্কে এক যুগে ১২ জিরাফের মৃত্যুতে শোকের ছায়া

Advertisement

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা সাফারি পার্ক এখন জিরাফশূন্য

গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে বেঁচে থাকা শেষ জিরাফটিও মারা গেছে। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ এই স্ত্রী জিরাফটি টিউবারকুলোসিস (টিবি) রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
শনিবার সকালে পার্ক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমে নিশ্চিত করেছে।

এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সাফারি পার্কের একসময়ের আকর্ষণীয় প্রাণী ‘জিরাফ পরিবার’ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হলো। গত এক দশকে পার্কে মারা গেছে মোট ১২টি জিরাফ, যা এখন গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে বন্যপ্রাণীপ্রেমীদের মধ্যে।

চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ জিরাফটির মৃত্যু

পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তারেক রহমান জানান,

“গত এক সপ্তাহ ধরে জিরাফটি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। দ্রুত আমরা একটি বিশেষ মেডিকেল বোর্ড গঠন করি। পরীক্ষার পর জানা যায়, এটি টিবিতে আক্রান্ত। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও আমরা ওটিকে বাঁচাতে পারিনি।”

পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, মৃত্যুর পর শুক্রবার বিকেলে শ্রীপুর থানায় এ বিষয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে।
বন্যপ্রাণী পরিদর্শক রাজু আহমেদ জিডিটি দায়ের করেন, যেখানে উল্লেখ রয়েছে —
২৩ অক্টোবর বিকেল ৪টার দিকে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমদানি করা ওই পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী জিরাফটি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। পরে মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন এবং প্রতিবেদনে নিশ্চিত করেন— প্রাণীটি টিউবারকুলোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।

দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আনা হয়েছিল ১২ জিরাফ

২০১৩ সালে সাফারি পার্ক প্রতিষ্ঠার সময় দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ১২টি জিরাফ (পুরুষ ও স্ত্রী উভয়) আনা হয়।
সেই সময় গাজীপুরবাসীসহ সারাদেশের মানুষ উচ্ছ্বসিত হয়েছিল এমন বৈচিত্র্যময় প্রাণী দেখে।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে শুরু হয় দুর্ভাগ্যের অধ্যায়।

পার্ক সূত্রে জানা যায়—
২০১৩ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই ১২টি জিরাফের একে একে মৃত্যু হয়।
২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ৯টি জিরাফ মারা যায় নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে।
এরপর ২০২৩ সালের ২০ অক্টোবর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে একটি জিরাফ মারা যায়।
২০২৪ সালে মারা যায় আরও একটি স্ত্রী জিরাফ।
আর ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে মৃত্যুবরণ করল শেষ জিরাফটি।

জিরাফের মৃত্যুর কারণ নিয়ে প্রশ্ন

বিশেষজ্ঞদের মতে, টিবি বা টিউবারকুলোসিস একটি সংক্রামক ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ, যা মানুষ ও প্রাণী উভয়ের ক্ষেত্রেই মারাত্মক।
গবেষণা বলছে, সাফারি পার্কে বদ্ধ পরিবেশে দীর্ঘদিন থাকা, অনুপযুক্ত বায়ুচলাচল ও অন্যান্য প্রাণীর সংস্পর্শে আসা— এসব কারণে প্রাণীগুলো ধীরে ধীরে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহীন আহমেদ বলেন,

“জিরাফ হলো সংবেদনশীল বন্যপ্রাণী। পর্যাপ্ত মুক্ত পরিবেশ, সুষম খাদ্য ও পরিচ্ছন্নতা না থাকলে এদের টিবি, ক্যানসার বা লিভারের সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাফারি পার্কে সঠিকভাবে এসব ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত না হওয়াই হয়তো মৃত্যুর মূল কারণ।”

সাফারি পার্কের প্রাণী ব্যবস্থাপনায় অবহেলার অভিযোগ

গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক একসময় দেশের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ ছিল।
এখানে সিংহ, বাঘ, জেব্রা, চিতা, হাতি, হরিণ, ভালুক, উটপাখি— এমন বহু বিদেশি প্রাণী দেখা যেত।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাণী মৃত্যুর হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে।

পার্কের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পর্যাপ্ত চিকিৎসক, আধুনিক ল্যাব সুবিধা ও বিশেষজ্ঞ ভেটেরিনারি টিমের অভাবে প্রাণীদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয় না।
ফলে অসুস্থতা ধরা পড়ে অনেক দেরিতে, তখন চিকিৎসা সফল হয় না।

প্রাণী অধিকারকর্মীরা বলছেন—

“প্রাণীদের শুধু আনা নয়, তাদের জীবনের নিরাপত্তা ও মানসম্মত যত্ন নিশ্চিত করাও সরকারের দায়িত্ব। একের পর এক মৃত্যুর ঘটনায় স্বচ্ছ তদন্ত প্রয়োজন।”

পর্যটন আকর্ষণে বড় ধাক্কা

জিরাফ ছিল সাফারি পার্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রাণী
দীর্ঘ গলা, শান্ত স্বভাব ও অদ্ভুত সুন্দর চলন— শিশু থেকে বয়স্ক, সবার মন জয় করেছিল এই প্রাণীগুলো।
প্রতিদিন হাজারো দর্শনার্থী শুধুমাত্র জিরাফ দেখতেই পার্কে আসতেন।

শেষ জিরাফটির মৃত্যুর পর পার্ক এখন জিরাফশূন্য
ফলে পর্যটন রাজস্ব ও দর্শনার্থীর আগ্রহেও বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: আবার কি ফিরবে জিরাফ?

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন করে দক্ষিণ আফ্রিকা বা কেনিয়া থেকে জিরাফ আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
তবে এবার তারা উন্নত কোয়ারেন্টাইন সেন্টার, বিশেষ চিকিৎসা ইউনিট ও রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি না করে নতুন জিরাফ আনার পক্ষে নন।

অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,

“আমরা জানি, মানুষের ট্যাক্সের টাকায় আনা এসব প্রাণী একে একে মারা যাচ্ছে। এবার যেভাবেই হোক সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, না হলে ইতিহাস আবারও নিজেকে পুনরাবৃত্তি করবে।”

প্রাণী সংরক্ষণে করণীয়

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের প্রতিটি সাফারি পার্ক ও চিড়িয়াখানায় একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রাণী স্বাস্থ্য ল্যাব থাকা উচিত।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, খাদ্য তালিকা নিয়ন্ত্রণ, পর্যাপ্ত খেলার জায়গা এবং প্রজনন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত না করলে এমন মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব নয়।

এছাড়া, কর্মীদের প্রশিক্ষণ, বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা ও প্রাণীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিই হতে পারে ভবিষ্যৎ সমাধান।

শোক ও ক্ষোভ একসাথে

গাজীপুরের স্থানীয় বাসিন্দা এবং পার্কের নিয়মিত দর্শনার্থীরা বলছেন—

“আমরা চোখের সামনে একে একে সব জিরাফকে হারিয়েছি। অথচ কেউ জবাব দেয় না কেন তারা মরছে।”

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও জিরাফের মৃত্যুর খবরে নেটিজেনদের মধ্যে শোকের ঢল নেমেছে।
অনেকে লিখেছেন,

“একটা দেশের উন্নয়ন তখনই অর্থবহ, যখন সেখানে প্রাণীগুলোও নিরাপদে বাঁচতে পারে।”

অতীতের স্মৃতি হয়ে থাকবে জিরাফ

সাফারি পার্কের কর্মীদের অনেকেই জানালেন, শেষ জিরাফটি ছিল পার্কের সবচেয়ে শান্ত স্বভাবের প্রাণী।
প্রতিদিনই দর্শনার্থীরা তাকে দেখতে ভিড় করত। এখন সে শুধু স্মৃতি।

পার্কের প্রবীণ কর্মী আবদুল খালেক বলেন,

“আমি ১২ বছর ধরে এখানে কাজ করি। প্রথম যখন জিরাফগুলো এসেছিল, মনে হয়েছিল স্বপ্নের মতো। আজ মনে হয়, আমরা সেই স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেছি।”

একসময় গাজীপুর সাফারি পার্কে জিরাফ ছিল আনন্দের প্রতীক, আজ তা শোকের স্মৃতি।
প্রাণীর মৃত্যুর পেছনে শুধু রোগ নয়, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, পরিবেশগত অব্যবস্থা ও অবহেলাও সমানভাবে দায়ী।
এখন সময় এসেছে, এই ঘটনাকে শিক্ষা হিসেবে নিয়ে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে নতুনভাবে সাজানোর।
কারণ—
প্রকৃতি বাঁচলে তবেই বাঁচবে মানুষ, প্রাণী আর এই সুন্দর পৃথিবী।

MAH – 13474 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button