ফ্যাক্ট চেক

বদনজর থেকে বাঁচতে শিশুর কপালে কালো টিপ, কুসংস্কার ছাড়া কিছু না

Advertisement

বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের অনেক পরিবারেই একটি প্রচলিত রীতি হলো শিশুর কপালে কালো টিপ লাগানো। বিশ্বাস করা হয়, এতে শিশুর ওপর কোনো বদনজর পড়বে না। শিশুর সৌন্দর্য নষ্ট করে তাকে অশুভ দৃষ্টি থেকে রক্ষা করার এ ধারণা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। বিশেষ করে মা-বাবারা মনে করেন, কালো টিপ একটি প্রতিরক্ষামূলক চিহ্ন হিসেবে কাজ করে।

কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি ধর্মীয়ভাবে কতটুকু গ্রহণযোগ্য, কিংবা বৈজ্ঞানিকভাবে এর কোনো প্রমাণ আছে কি না—এই প্রশ্নটি আজকের সমাজে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ: কী বলে ইসলাম

ইসলামে বদনজর বা নজর লাগার বাস্তবতা স্বীকৃত। হাদিসে উল্লেখ আছে, নবী করিম (সা.) বদনজরের ক্ষতি থেকে আশ্রয় চেয়েছেন। তবে শিশুর কপালে কালো টিপ লাগানোকে ইসলামী শরীয়তে বাধ্যতামূলক বা সুন্নত কোনো প্রক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি।

একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, হজরত ওসমান (রা.) এক শিশুকে দেখে তার চিবুকে একটি কালো দাগ দিতে বলেছিলেন, যাতে অশুভ দৃষ্টি থেকে সুরক্ষিত থাকে। তবে এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, এটি একটি সাময়িক ব্যবস্থা ছিল—কোনো অলৌকিক প্রতিরক্ষা নয়।

ধর্মীয় আলেমরা বলেন, কালো টিপকে যদি শুধুমাত্র সৌন্দর্য কমানোর প্রতীক মনে করা হয়, তবে এতে গোনাহ নেই। কিন্তু যদি এটিকে অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন বা বদনজর প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হিসেবে বিশ্বাস করা হয়, তবে সেটি কুসংস্কার ও গর্হিত কাজ হিসেবে গণ্য হবে।

বদনজর থেকে বাঁচার ইসলামী উপায়

নবী করিম (সা.) বদনজর থেকে বাঁচতে বিভিন্ন দোয়া পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর নাতি হাসান ও হোসাইন (রা.)–এর জন্য তিনি বিশেষ দোয়া করতেন।


দোয়া: “উইজুকা বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মাতি মিন কুল্লি শাইতানিউঁ ওয়া হাম্মাতিউঁ ওয়া মিন কুল্লি আইনিন লাম্মাহ।”
অর্থ: “আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ বাণীসমূহের ওসিলায় প্রত্যেক শয়তান, কষ্টদায়ক প্রাণী এবং প্রত্যেক ক্ষতিকর দৃষ্টি থেকে তোমার জন্য আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।”

এছাড়া সকালে ও সন্ধ্যায় সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক ও সুরা নাস তিনবার করে পড়ে শিশুর গায়ে ফুঁ দিতে বলা হয়েছে। হাদিসে উল্লেখ আছে, এটি বদনজরসহ বিভিন্ন ক্ষতি থেকে সুরক্ষা দেয়।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ: সত্য নাকি কুসংস্কার?

বিজ্ঞান কোনোভাবেই কালো টিপকে বদনজর প্রতিরোধক হিসেবে মানে না। এটি কেবল মানুষের মানসিক বিশ্বাস ও সংস্কৃতির অংশ। আসলে কালো টিপ শিশুকে বদনজর থেকে রক্ষা করে—এমন কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা নেই।

তবে কিছু শিশু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, কালো টিপ লাগানোর কারণে অনেক সময় শিশুর ত্বকে অ্যালার্জি বা সংক্রমণ হতে পারে। বিশেষ করে কালি বা রাসায়নিক উপাদানযুক্ত টিপ ব্যবহার করলে তা শিশুর ত্বকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই চিকিৎসকরা সাধারণত এ ধরনের প্রথা পরিহার করার পরামর্শ দেন।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু করে শহর পর্যন্ত এই প্রথা বহুল প্রচলিত। অনেক মা-বাবা এটিকে ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে নেন। তবে শিক্ষিত ও সচেতন অংশ এটিকে কুসংস্কার হিসেবে চিহ্নিত করছেন।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের মধ্যে ভয় বা অনিশ্চয়তা থেকেই কুসংস্কারের জন্ম। শিশুকে বিপদ থেকে বাঁচাতে মানুষ সহজ ও দৃশ্যমান কোনো প্রতীক খুঁজে নেয়। কালো টিপ তারই বহিঃপ্রকাশ।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কালো টিপ কোনো সমস্যা নয় যদি এটিকে প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এটিকে অতিপ্রাকৃত শক্তি হিসেবে বিশ্বাস করা ভুল।
চিকিৎসকরা বলছেন, শিশুর ত্বকে রাসায়নিক টিপ ব্যবহার না করে নিরাপদ প্রসাধনী বা একেবারেই কিছু ব্যবহার না করাই ভালো।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষকে সচেতন করা দরকার যাতে কুসংস্কার নয়, বরং বাস্তব জ্ঞান ও ধর্মীয় নির্দেশনাই অনুসরণ করে।

পরিশেষে

শিশুর কপালে কালো টিপ দেওয়ার প্রচলন প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। কিন্তু বাস্তবে এটি বদনজর প্রতিরোধ করে—এমন কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। ইসলামও বদনজর থেকে রক্ষার মূল উপায় হিসেবে দোয়া ও আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার কথাই বলেছে।

সুতরাং, শিশুর কপালে কালো টিপ দেওয়া হয়তো একটি সামাজিক সংস্কৃতি, কিন্তু এর ওপর অন্ধ বিশ্বাস কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। প্রকৃত সুরক্ষা আসে সচেতনতা, দোয়া এবং সঠিক যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে।

এম আর এম – ১০৬২, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button