
সমাজে একটি প্রচলিত মত রয়েছে—মৃত্যুর পর ভাই-বোনের আর কখনও দেখা হবে না। অনেকেই বিষয়টিকে ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ হিসেবে মেনে চলেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলাম কী বলে এ বিষয়ে? ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মৃত্যুর পর আত্মীয়স্বজন, বিশেষ করে ভাই-বোনের মধ্যে পুনর্মিলনের কোনো সুযোগ রয়েছে কি না, তা নিয়ে রয়েছে নানা মতামত।
এই প্রতিবেদনে আমরা কুরআন-হাদীসের আলোকে এবং ইসলামি চিন্তাবিদদের বক্তব্যের মাধ্যমে বিষয়টি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব।
মৃত্যুর পর ভাই-বোনের সাক্ষাৎ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা
বাংলাদেশসহ অনেক মুসলিমপ্রধান দেশে একটি কথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত—মৃত্যুর পর ভাই-বোনের আর দেখা হয় না। কেউ কেউ এটি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন এবং পরস্পরের প্রতি শেষ দেখা কিংবা বিদায়ের সময় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন এই ধারণা থেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ নিয়ে অনেক সময় বিভিন্ন আবেগময় পোস্ট দেখা যায়।
তবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির সত্যতা কতটুকু? ইসলাম এই বক্তব্যকে সমর্থন করে কি?
ইসলামের দৃষ্টিতে বিষয়টির ব্যাখ্যা
এই বিষয়ে ইসলামি স্কলারগণ পরিষ্কারভাবে বলেন, মৃত্যুর পর ভাই-বোনের সাক্ষাৎ না হওয়ার কোনো বিষয় কুরআন বা সহিহ হাদীসে নেই। বরং পরকালীন জীবন, জান্নাত-জাহান্নাম, এবং কিয়ামতের দিন মানুষের সাক্ষাৎ বা পুনর্মিলনের বিষয় বারবার এসেছে ধর্মগ্রন্থে।
বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ শায়খ আহমাদুল্লাহ এই বিষয়ে বলেন, “মৃত্যুর পর ভাই-বোনের দেখা হবে না—এমন কোনো কথা কুরআন-হাদীসে বলা হয়নি। এটি একান্তই মনগড়া একটি কথা।”
তিনি আরও বলেন, যদি ভাই-বোন উভয়ে জান্নাতি হন, তবে পরকালে তাদের দেখা ও মিলন অবশ্যম্ভাবী। কুরআনের বহু আয়াতে জান্নাতিদের পরস্পরের সঙ্গে আনন্দে বসবাসের কথা বলা হয়েছে।
কুরআনের আলোকে ব্যাখ্যা
সুরা আবাসা, আয়াত ৩৪–৩৬-এ বলা হয়েছে:
“সেদিন মানুষ পালিয়ে যাবে তার ভাইয়ের কাছ থেকে, তার মায়ের ও পিতার কাছ থেকে, তার স্ত্রীর ও সন্তানদের কাছ থেকে।”
এই আয়াত দ্বারা বোঝানো হয়েছে, কিয়ামতের দিনে ভয়ের কারণে মানুষ তার সবচেয়ে আপনজন থেকেও মুখ ফিরিয়ে নেবে। এটি সাক্ষাৎ না হওয়ার কোনো প্রমাণ নয়। বরং এটি মানুষের ভীতি, জবাবদিহির ভয় এবং নিজের নিয়ে ব্যস্ত থাকার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
এখান থেকে এটা প্রমাণিত হয় না যে পরকালে তাদের সাক্ষাৎ হবে না। বরং জান্নাতবাসীদের মাঝে মিলন হবে, এবং তারা একত্রে শান্তিতে বসবাস করবে।
হাদীসের আলোকে ব্যাখ্যা
বহু সহিহ হাদীসে এসেছে, কিয়ামতের পর যারা জান্নাতে যাবে, তারা তাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “মানুষ তার সাথে যারা ছিল, তাদের সঙ্গেই থাকবে।”
অর্থাৎ, কেউ যদি পরহেজগার হয় এবং জান্নাতপ্রাপ্ত হয়, তাহলে তার প্রিয়জনদের সঙ্গ সে পুনরায় পাবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, ভাই-বোনের দেখা না হওয়ার কোনো ভিত্তি ইসলামে নেই।
বিশ্লেষকদের মতামত
ধর্মীয় বিশ্লেষকগণ মনে করেন, ভাই-বোনের দেখা না হওয়ার মত প্রচলিত ধারণাগুলো মূলত মানুষের আবেগ বা সংস্কার থেকে এসেছে। ধর্মের প্রকৃত ব্যাখ্যা না জানার কারণে এমন ভুল বোঝাবুঝি সমাজে ছড়িয়ে পড়ে।
ইসলাম একটি বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিবাদী ধর্ম। কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট ব্যাখ্যা ছাড়া কোনো মতবাদ গ্রহণ করা ইসলামী দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়।
সামাজিক প্রভাব ও ভুল প্রচারণার বিপদ
মৃত্যুর পর ভাই-বোনের সাক্ষাৎ না হওয়ার এই ধারণা সমাজে অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় আতঙ্ক, দুঃখ এবং ভুল চিন্তা তৈরি করে। কেউ কেউ এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে ধর্ম নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন বা ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেন।
এই কারণে, প্রত্যেক মুসলমানের উচিত কুরআন ও সহিহ হাদীস থেকে জ্ঞান গ্রহণ করা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা করে কোনো তথ্য বিশ্বাস করা।
সারসংক্ষেপ
ইসলাম কখনোই বলেনি যে মৃত্যুর পর ভাই-বোনের দেখা হবে না। বরং ইসলামী দৃষ্টিতে, যদি উভয়েই জান্নাতপ্রাপ্ত হন, তবে তারা পুনরায় মিলিত হবেন এবং শান্তিতে বসবাস করবেন। কিয়ামতের দিনের ভয়াবহতা বর্ণনার উদ্দেশ্যে কিছু আয়াতে পরস্পরের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হলেও, তা চিরতরের বিচ্ছেদ নয়।
তাই মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিত ভ্রান্ত ধারণার পরিবর্তে বিশুদ্ধ ইসলামি জ্ঞানের ভিত্তিতে বিশ্বাস গঠন করা।
এম আর এম – ০৭৩১, Signalbd.com