
মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর গোটা মদিনা নগরী নেমে যায় গভীর শোকের ছায়ায়। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) কেউই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে নবীজি (সা.) দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছেন। বেদনার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলেন সবাই। শোকে মুহ্যমান এই মুহূর্তেই ধীরে ধীরে শুরু হয় কাফন ও দাফনের প্রস্তুতি।
সাহাবাদের শোক ও নেতৃত্ব নির্ধারণের আলোচনা
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর প্রথম যে বিষয়টি সামনে আসে তা হলো— নবীজির (সা.) স্থলাভিষিক্ত বা নেতৃত্বের দায়িত্ব কে নেবেন। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এ নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে মতবিনিময় করতে থাকেন। কেউ কেউ মুহাজিরদের নেতৃত্বের পক্ষে যুক্তি দেন, আবার কেউ আনসারদের পক্ষে মত দেন। অবশেষে আবু বকর (রা.)-এর নেতৃত্বে ঐক্যমত্য হয়। এতে কিছুটা সময় লেগে যায়, ফলে দাফনের প্রস্তুতি শুরু হতে বিলম্ব ঘটে।
দেহ মোবারক গোসলের আয়োজন
সোমবার রাত পেরিয়ে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত নবীজি (সা.)-এর পবিত্র দেহ মোবারক একটি ইয়েমেনি চাদর দ্বারা আবৃত অবস্থায় ছিল। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। এরপর মঙ্গলবার দিনে তাঁর গোসলের ব্যবস্থা করা হয়। গোসলের কাজে অংশ নেন আব্বাস (রা.), আলী (রা.), আব্বাস (রা.)-এর ছেলে ফজল ও কাশেম (রা.)। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় সাহাবি ও সেবক শাকরান, উসামা বিন জায়েদ এবং আউস বিন খাওলি (রা.)।
গোসলের সময় দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া হয়েছিল। আব্বাস, ফজল ও কাশেম (রা.) নবীজির (সা.) শরীর ঘোরানোর দায়িত্ব পালন করেন। উসামা ও শাকরান (রা.) পানি ঢেলে দেন। আলী (রা.) গোসল করানোর কাজ করেন। আর আউস (রা.) নবীজির (সা.) দেহ মোবারককে নিজের বুকে ধরে রাখেন।
বিশেষ পানি ও কাফনের কাপড়
রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে তিনবার কুলপাতা মিশ্রিত পানি দিয়ে গোসল করানো হয়। এ পানি নেওয়া হয়েছিল কুবা এলাকার “গারস” নামের কূপ থেকে—যে পানি নবীজি (সা.) জীবদ্দশায় পান করতেন। গোসল শেষে কাফনের জন্য তিনটি সাদা ইয়েমেনি কাপড় ব্যবহার করা হয়। কোনো জামা বা পাগড়ি এতে ছিল না। এভাবেই নবীজি (সা.)-এর দেহ মোবারক কাফন করা হয়।
কোথায় হবে দাফন: মতভিন্নতা ও সমাধান
দাফনের স্থান নির্ধারণ নিয়েও সাহাবাদের মধ্যে মতভেদ হয়। কেউ কেউ চেয়েছিলেন, মদিনার বাইরে জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হোক। তবে আবু বকর (রা.) সাহাবাদের উদ্দেশে বলেন, নবীজি (সা.)-কে আমি বলতে শুনেছি: “যে স্থানে কোনো নবী মৃত্যুবরণ করেন, সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়।” এই হাদিস শুনে সবাই একমত হন। এরপর নবীজি (সা.) যে বিছানায় ইন্তেকাল করেছিলেন সেটি সরিয়ে তার নিচে কবর খোঁড়া হয়।
জানাজার নামাজের পদ্ধতি
নবীজি (সা.)-এর জানাজার নামাজে কোনো নির্দিষ্ট ইমাম ছিলেন না। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ১০ জন করে পালাক্রমে ঘরে প্রবেশ করে জানাজা আদায় করেন। প্রথমে বনু হাশিম পরিবার, তারপর মুহাজিরগণ, আনসারগণ এবং শেষে সাধারণ মুসলমানরা—সবাই অংশ নেন। নারী ও শিশুরাও জানাজায় শরিক হয়েছিলেন। মঙ্গলবার পুরো দিন এই জানাজা আদায়ে কেটে যায়।
দাফনের মুহূর্ত
জানাজার নামাজ শেষ হওয়ার পর বুধবার রাতের মধ্যভাগে নবীজি (সা.)-এর দাফন সম্পন্ন করা হয়। হযরত আয়েশা (রা.)-এর বর্ণনা অনুযায়ী, জানাজার নামাজের ব্যস্ততায় তাঁরা বুঝতেই পারেননি কখন দাফন শুরু হয়েছে। বুধবার রাত গভীর হওয়ার পর দাফনের শব্দ তাঁদের কানে আসে। এভাবেই গভীর শোকের আবহে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দাফন সম্পন্ন হয়।
মুসলিম উম্মাহর জন্য শিক্ষা
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাফন ও দাফনের এই পুরো প্রক্রিয়া মুসলিম উম্মাহকে ধৈর্য, নিয়মশৃঙ্খলা এবং ঐক্যের মূল্য শিখিয়ে যায়। সাহাবাদের পরস্পরের প্রতি সহযোগিতা ও সঠিক পদ্ধতিতে তাঁর দাফন সম্পন্ন করার ঘটনাটি ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে।
মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর শোকের আবহে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) অত্যন্ত মর্যাদা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে তাঁর কাফন ও দাফনের কাজ সম্পন্ন করেন। আজও এই ঘটনাগুলো মুসলমানদের জন্য শিক্ষার উৎস হয়ে আছে।
এম আর এম – ০৬৭২, Signalbd.com