ইসলামের ইতিহাসে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি এমন এক নাম, যিনি তাঁর অসাধারণ রণকৌশল ও নেতৃত্বগুণের মাধ্যমে মুসলমানদের হাতে পুনরায় ফিরিয়ে এনেছিলেন পবিত্র জেরুজালেম নগরী। দীর্ঘ ৯০ বছর ক্রুসেডারদের দখলে থাকার পর ১১৮৭ সালে তিনি যে বিজয় অর্জন করেন, তা আজও বিশ্ব ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়।
জেরুজালেমের প্রথম দখল ও ক্রুসেডারদের আগমন
৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর সময় রোমানদের কাছ থেকে মুসলমানদের হাতে আসে জেরুজালেম। এরপর প্রায় পাঁচ শতাব্দী ধরে এ নগরী মুসলিম শাসনের অধীনে ছিল। কিন্তু ১০৯৯ সালে মুসলিম শাসকদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ইউরোপীয় ক্রুসেডাররা পবিত্র নগরী দখল করে নেয়। ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞে তারা প্রায় ৭০ হাজার মুসলমানকে হত্যা করে এবং শহরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে।
সালাহউদ্দিন আইয়ুবির উত্থান
১২ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি মিসরের শাসনভার গ্রহণ করেন। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং ক্রুসেডারদের কবল থেকে ইসলামের পবিত্র স্থানগুলো মুক্ত করা। তিনি ধাপে ধাপে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে ক্রুসেডারদের পরাজিত করতে শুরু করেন এবং ১১৭৯ সালের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের একটি বিশাল ভূখণ্ডকে একক ইসলামী নেতৃত্বের অধীনে আনেন।
যুদ্ধের পূর্ববর্তী পরিস্থিতি
সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলমানরা শক্তিশালী হতে থাকলে ক্রুসেডাররা বিভক্ত হয়ে পড়ে। জেরুজালেমে তখন গাই অব লুজিনান শাসক হলেও তাঁর বিরুদ্ধে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে রেনল্ড ডি শাতিওন নামের এক খ্রিস্টান শাসক সালাহউদ্দিনের সঙ্গে করা শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করেন। এতে নতুন করে যুদ্ধের সূচনা হয়।
হিত্তিনের মহাযুদ্ধ: রণকৌশলের অসাধারণ উদাহরণ
১১৮৭ সালের জুলাই মাসে সালাহউদ্দিন তাঁর বাহিনী নিয়ে তাবারিয়া অঞ্চলে ক্রুসেডারদের ফাঁদে ফেলেন। সেখানে পানি সরবরাহের সব উৎস আগে থেকেই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন তিনি। প্রচণ্ড গরমে এবং তৃষ্ণায় দুর্বল হয়ে পড়া ক্রুসেডার বাহিনীকে ৪ জুলাই হিত্তিনের ময়দানে ঘেরাও করা হয়। মাত্র ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে সালাহউদ্দিন মুখোমুখি হন প্রায় ৬০ হাজার ক্রুসেডারের। কিন্তু তাঁর সুপরিকল্পিত রণকৌশল ও মনোবল মুসলিম বাহিনীকে জয় এনে দেয়।
এই যুদ্ধে ক্রুসেডার বাহিনীর বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হয়। গাই অব লুজিনান বন্দী হন, আর রেনল্ড ডি শাতিওনকে সালাহউদ্দিন নিজ হাতে মৃত্যুদণ্ড দেন। হিত্তিনের যুদ্ধই জেরুজালেম মুক্তির দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়।
জেরুজালেমের অবরোধ ও শান্তিপূর্ণ মুক্তি
হিত্তিনের যুদ্ধের পর সালাহউদ্দিন ১১৮৭ সালের সেপ্টেম্বরে জেরুজালেম ঘিরে ফেলেন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ক্রুসেডাররা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। সালাহউদ্দিন তাদের জন্য মানবিক সিদ্ধান্ত নেন— মুক্তিপণের বিনিময়ে শহর ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ দেন, আর যারা দরিদ্র, তাদের বিনা মুক্তিপণেই মুক্তি দেন।
তাঁর এই আচরণ ক্রুসেডারদের হতবাক করে দিয়েছিল, কারণ ১০৯৯ সালে ক্রুসেডাররা একই শহরে যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, সালাহউদ্দিন তার সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ দেখান। তাঁর মানবিকতা ইতিহাসে নজিরবিহীন উদাহরণ হয়ে আছে।
ইসলামের ইতিহাসে এই বিজয়ের গুরুত্ব
জেরুজালেম বিজয় শুধু একটি শহর পুনরুদ্ধারের ঘটনা ছিল না; এটি ছিল মুসলিম ঐক্য ও দৃঢ় নেতৃত্বের প্রতীক। এই ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, জ্ঞান, রণকৌশল এবং ন্যায়ের শক্তিই প্রকৃত বিজয় এনে দেয়।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
ইতিহাসবিদদের মতে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবির নেতৃত্ব ছাড়া জেরুজালেম কখনো মুসলমানদের হাতে ফিরতো না। তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, সামরিক দক্ষতা এবং মানবিক আচরণ তাঁকে বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
উপসংহার
পবিত্র জেরুজালেমের মুক্তি শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, মানবতার ইতিহাসের জন্য একটি অনন্য উদাহরণ। সালাহউদ্দিন আইয়ুবির কীর্তি আজও বিশ্ববাসীকে শিখিয়ে যায় যে, নেতৃত্ব মানে শুধু ক্ষমতা নয়; বরং দূরদর্শিতা, নৈতিকতা ও মানবিকতার সমন্বয়।
এম আর এম – ০৬১৫ , Signalbd.com



