আঞ্চলিক

স্ত্রী কালো হওয়ায় পুড়িয়ে হত্যার মামলায় ভারতে স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

Advertisement

ভারতের রাজস্থানের উদয়পুরে এক হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের মামলায় আদালত ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেছে। স্ত্রীর গায়ের রং কালো হওয়ায় পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগে স্বামী কিষাণ দাসকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ আট বছর ধরে চলা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলো বুধবার, যা এখন পুরো ভারতজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

এই ঘটনা কেবল একটি হত্যা নয়; এটি নারীর প্রতি বিদ্বেষ, ত্বক-রঙের বৈষম্য এবং পারিবারিক নির্যাতনের ভয়াবহ উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হলো।

মামলার পটভূমি: এক নারীর স্বপ্নভঙ্গের করুণ কাহিনী

২০১৬ সালে ভুক্তভোগী লক্ষ্মী দেবী (২০) এবং অভিযুক্ত কিষাণ দাস বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। শুরুতে সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেও বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই লক্ষ্মীর গায়ের রং নিয়ে কটাক্ষ শুরু করেন স্বামী।

কৃষ্ণ দাস প্রায়ই তাকে ‘কালি’ বলে অপমান করতেন। পরিবার এবং প্রতিবেশীদের কাছে অপমানজনক মন্তব্য করতেন, যার ফলে লক্ষ্মী চরম মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে পড়েন। ধীরে ধীরে এ মানসিক নির্যাতন শারীরিক নির্যাতনে রূপ নেয়।

হত্যার রাত: ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র

২০১৭ সালের এক রাতে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। কিষাণ দাস স্ত্রীকে বলেন, তার কাছে এমন একটি মেডিসিন আছে যা ত্বক ফর্সা করে দেবে। সরল বিশ্বাসে লক্ষ্মী ওই তরল পদার্থ গায়ে মাখতে শুরু করেন। কিন্তু তরলটির গন্ধে তিনি কিছুটা সন্দেহ করেন এবং বলেন, এতে এসিডের মতো গন্ধ।

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই কিষাণ দাস হঠাৎ আগুন ধরিয়ে দেন এবং পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করেন। আগুনে মারাত্মকভাবে পুড়ে যাওয়ার পরও লক্ষ্মী বেঁচে ছিলেন কিছু সময়। হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি পুলিশকে পুরো ঘটনা জানান এবং মৃত্যুর আগে নিজের বয়ান রেকর্ড করেন।

আদালতের রায়: ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’

আট বছরের দীর্ঘ তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়ার পর উদয়পুরের জেলা আদালত কিষাণ দাসকে ফাঁসির দণ্ড দেয়।

রায় ঘোষণার সময় বিচারক রাহুল চৌধুরী বলেন:

“এটি শুধুমাত্র একটি খুন নয়, এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। একজন নারীকে শুধু গায়ের রং কালো হওয়ার কারণে হত্যা করা সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। অভিযুক্ত স্ত্রী’র বিশ্বাস ভেঙেছেন, তার শরীর আগুনে জ্বলছিল তবুও বাকি তরল ঢেলে দেন – যা চরম নিষ্ঠুরতার প্রমাণ।”

রাষ্ট্রপক্ষের মন্তব্য: “এই রায় শিক্ষা হয়ে থাকবে”

সরকারি কৌঁসুলি দীনেশ পালিওয়াল এই রায়কে ঐতিহাসিক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন:

“একজন ২০ বছরের তরুণীকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তা সভ্য সমাজের জন্য কলঙ্ক। এই রায় অন্যদের জন্য শিক্ষা হয়ে থাকবে। আমরা চাই, ভবিষ্যতে আর কোনো নারী এভাবে নির্যাতনের শিকার না হন।”

দীনেশ আরও জানান, রায়টি হাইকোর্টে পাঠানো হয়েছে অনুমোদনের জন্য। অভিযুক্তের কাছে আপিলের সুযোগ থাকলেও তিনি মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার ব্যাপারে আশাবাদী।

কেন এমন ঘটনা ঘটছে? ভারতজুড়ে বিতর্ক

এই ঘটনার পর ভারতজুড়ে নতুন করে ত্বক-রঙ বৈষম্য, নারী নির্যাতন এবং পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতীয় উপমহাদেশে ফর্সা ত্বকের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ বহুদিনের। সিনেমা, বিজ্ঞাপন ও সামাজিক সংস্কৃতি ফর্সা ত্বককে সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসেবে তুলে ধরেছে। এর ফলে অনেকেই অন্ধভাবে ফর্সা হওয়ার ক্রিম বা উপায় খোঁজেন, যা কখনও ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এই খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও শিরোনাম হয়েছে। BBC, The Guardian, Al Jazeera-র মতো গণমাধ্যমগুলো এ ঘটনাকে দক্ষিণ এশিয়ার কালারিজমজেন্ডার-বেসড ভায়োলেন্স-এর ভয়ঙ্কর উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, শুধু আইন দিয়ে নয়, মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে।

ভারতীয় আইনে স্ত্রী হত্যার শাস্তি

ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী (IPC Section 302), খুনের দায়ে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া যেতে পারে। নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে (IPC 498A) কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। তবে বাস্তবে দীর্ঘসূত্রিতা এবং সামাজিক প্রভাবের কারণে অনেক অপরাধী শাস্তি এড়ায়। এই রায়কে তাই এক নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

MAH – 12632,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button