বাংলাদেশ

শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদণ্ডের আবেদন

Advertisement

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ চরম দণ্ডের (মৃত্যুদণ্ড) আবেদন করেছে। চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ যুক্তিতর্ক শেষ করে এই আবেদন জানান।

আজ ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটরের পক্ষ থেকে বলা হয়, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় মোট ১৪০০ জন ছাত্র ও সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন। “যদি একজন হত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রযোজ্য হয়, তবে ১৪০০ মানুষের হত্যার জন্য ১৪০০ বার মৃত্যুদণ্ড প্রয়োজন হবে। আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে তা সম্ভব নয়, তাই আমরা মানবতাবিরোধী অপরাধের ভিত্তিতে চরম দণ্ডের আবেদন করছি। এ দণ্ড দিলে দেশের জনগণ ন্যায়বিচার পাবে,” বলেন চিফ প্রসিকিউটর।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি ও প্রমাণাদি

চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া পরও ভারতের সীমান্ত থেকে আন্দোলনকারীদের হত্যার হুমকি দিয়েছেন। যারা বিচার চেয়েছেন তাদেরকে নির্মূল করার পরিকল্পনা করেছেন। এছাড়া বাড়িঘর পোড়ানোর হুমকিও দিয়েছেন। এসব বিবরণ থেকে বোঝা যায়, এত হত্যাকাণ্ডের পরও তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। তাই তার বিরুদ্ধে চরম দণ্ডের আবেদন ন্যায়সঙ্গত।

আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে প্রসিকিউটর বলেন, তিনি ‘গ্যাং অব ফোর’-এর সদস্য ছিলেন এবং হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছেন। ড্রোন এবং হেলিকপ্টার ব্যবহার করে হত্যার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি নিজে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং ভিডিও প্রমাণের মাধ্যমে কমান্ড স্ট্রাকচারে তার অবস্থান দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়াও রাষ্ট্রপক্ষ আদালতের কাছে আবেদন করেছে, শহীদ ও আহতদের পরিবারদের ক্ষতিপূরণ দিতে আসামিদের সম্পদ ব্যবহার করা হোক। কারণ নিহতরা পরিবারে আলোর প্রদীপ ছিলেন এবং ভবিষ্যতে পরিবারের দায়িত্ব নিতেন।

রাষ্ট্রপক্ষের দীর্ঘ যুক্তিতর্ক

প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক বুধবার চতুর্থ দিনে গিয়েছে। এদিন বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত, প্রামাণ্যচিত্র এবং সাক্ষীদের বর্ণনা তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর। তৃতীয় দিনে, মঙ্গলবার, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের বিভিন্ন তথ্যচিত্র এবং শেখ হাসিনা, হাসানুল হক ইনু, শেখ ফজলে নূর তাপসের ফোনালাপ আদালতে বাজানো হয়। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে আন্দোলনের সময় কিভাবে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।

দ্বিতীয় দিনে, ১৩ অক্টোবর, রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনে আরও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এই প্রামাণ্যচিত্রগুলো মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে প্রসিকিউটর উল্লেখ করেছেন।

প্রসিকিউশন ১২ অক্টোবর থেকে তার যুক্তিতর্ক শুরু করে। ওই দিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষের বিশদ উপস্থাপনায় আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের বিভিন্ন ঘটনা, গুম-খুন এবং নারকীয় অপরাধের বিবরণ উপস্থাপন করা হয়। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এসব তথ্য এ মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ।

তদন্ত ও সাক্ষ্যগ্রহণ

গত ৮ অক্টোবর মামলার মূল তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীরকে তৃতীয় দিনের মতো জেরা শেষ করেন শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। এরপর ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল যুক্তিতর্কের দিন নির্ধারণ করেন।

মামলায় মোট ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে মামলার সকল গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদালতের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে।

অভিযোগ ও মামলা সংক্রান্ত তথ্য

১০ জুলাই ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। মামলায় পাঁচটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র মোট ৮,৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র ২,০১৮ পৃষ্ঠা, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি ৪,০০৫ পৃষ্ঠা এবং শহীদদের তালিকা ২,৭২৪ পৃষ্ঠার। সাক্ষী করা হয়েছে ৮১ জনকে।

প্রসিকিউটররা বলেন, মামলার তদন্ত সংস্থা ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে সব প্রমাণ ও তথ্যের বিস্তারিত বিবরণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

বিচার প্রক্রিয়ার প্রাসঙ্গিকতা

মামলাটি দেশের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ন। বিচার প্রক্রিয়ায় আইন, প্রমাণাদি এবং প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য সমানভাবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি শুধু ব্যক্তি নির্দিষ্ট বিচার নয়, একই সঙ্গে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও মানবাধিকার সংরক্ষণের প্রতিফলন। চিফ প্রসিকিউটর দাবি করেছেন, যদি আদালত আইন অনুযায়ী চরম দণ্ড দেন, তা দেশের জনগণের জন্য ন্যায়সঙ্গত হবে।

ট্রাইব্যুনালের পরবর্তী কার্যক্রম

বিচারিক প্যানেল পরবর্তী শুনানিতে আসামিদের প্রতিরক্ষা যুক্তিতর্ক শোনার জন্য দিন নির্ধারণ করবে। প্রতিরক্ষা পক্ষ আদালতের সামনে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করবেন এবং প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি উপস্থাপন করবেন।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মামলার দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং বিস্তারিত প্রমাণাদি বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেছে। এটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড অনুসরণ করে সম্পন্ন হচ্ছে।

সংক্ষেপে

১. চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম রাষ্ট্রপক্ষের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের চরম দণ্ডের আবেদন করেন।
২. জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় ১৪০০ জনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা মামলার প্রধান ভিত্তি।
৩. আসাদুজ্জামান খান কামাল হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের প্রধান সদস্য ছিলেন।
৪. আদালতে প্রামাণ্যচিত্র, ফোনালাপ, প্রত্যক্ষ সাক্ষীর বর্ণনা প্রদর্শন করা হয়েছে।
৫. মামলার তদন্ত সংস্থা ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়।
৬. মামলায় পাঁচটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
৭. আদালত প্রয়োজনীয় বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এবং পরিবারের ক্ষতিপূরণের বিষয়ও বিবেচনা করা হবে।

MAH – 13348 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button