ফ্যাক্ট চেক

ভাইরাল ছবির পেছনের গল্প পুলিশের গুলির মাঝেও ফটোসাংবাদিকের সাহস

Advertisement

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ছবির ঝড় উঠেছে জুলাই মাসে। ছবি দুটো ভাইরাল হয়েছে, যা শুধু একটি মুহূর্তই ধারণ করে নি, বরং দেশের সাম্প্রতিক আন্দোলনের এক জীবন্ত গল্প বলে। ছবি দুটির পেছনের সত্য ঘটনা শুনতে গেলে চোখের সামনে চলে আসে রক্ত, দুর্দান্ত সাহস আর কঠোর সংগ্রামের ছবি।

প্রথম আলোর আলোকচিত্রী খালেদ সরকার সেই ছবি তুলেছিলেন। কিন্তু ছবির পেছনের কাহিনি জানলে বোঝা যায়, সেটি ছিল ছবি তোলার চেয়ে বেশি কিছু — এক জীবন-মরণ যাত্রা।

১৯ জুলাইয়ের সকালের উত্তাল ঢাকা: পরিবারের অনুরোধ উপেক্ষা করে সড়কে নেমেছিলেন আলোকচিত্রী

১৯ জুলাই ছিল খালেদ সরকারের সাপ্তাহিক ছুটি। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি তখন উত্তপ্ত। ঢাকার নানা জায়গায় আন্দোলন শুরু হয়েছে, মানুষের পদযাত্রা, প্রতিবাদের গর্জন সারা শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। একজন পেশাদার ফটোসাংবাদিক হিসেবে, খালেদ ছুটির দিনটাও বাসায় বসে থাকতে পারলেন না।

পরিবারের সদস্যরা প্রথমে বাধা দিলেও, নিজের ইচ্ছে মেনে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। উত্তরা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের চেকপোস্ট পেরিয়ে তিনি পৌঁছান আন্দোলনস্থলে।

আগুনে পুড়ছে বিআরটিসির বাস, ভাঙছে ভবনের কাঁচ: উত্তাল দৃশ্যপট

স্কয়ার টাওয়ারের সামনে পৌঁছে দেখেন, বিআরটিসির একটি বাস দাউ দাউ করে জ্বলছে। পাশের বড় বড় ভবনের কাঁচও ভেঙে পড়ে। তার ক্যামেরায় ধরা পড়ে এসব হৃদয়বিদারক দৃশ্য।

খালেদের ক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়ে আন্দোলনের তীব্রতা, মানুষের ক্ষোভ এবং পুলিশ-জনতার সংঘর্ষের আগুন।

আজমপুর থানা ঘেরাওয়ের সময় ঘটে ভয়ঙ্কর ঘটনা

এরপর তিনি এগিয়ে যান আজমপুরের দিকে, যেখানে উত্তরা পূর্ব থানা ঘেরাও করার চেষ্টা চলছে। আন্দোলনকারীরা থানা ঘেরাওয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তেজিত হচ্ছিল।

খালেদ সেতুর ওপর থেকে ছবি তুলছিলেন, কিন্তু বুঝতে পারলেন এখান থেকে ভালো ছবি আসবে না, তাই নিচে নামার সিদ্ধান্ত নিলেন।

একটি মার্কেটের সিঁড়িতে অবস্থান নেন, ঠিক তখনই পুলিশ গুলি চালাতে শুরু করে। চারপাশে কাঁদানে গ্যাস, ছররা গুলি, রাবার বুলেটের ঝড় বইছে।

গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও ক্যামেরা থামেনি

পুলিশের গুলির মুখে পড়ে খালেদ সরকারের শরীরে চারটি ছররা গুলি লাগে। রক্ত ঝরতে থাকে, কিন্তু তিনি থামেননি। এক হাত দিয়ে ক্যামেরা ধরে রাখেন এবং ছবি তুলতে থাকেন।

একজন আর্জেন্টাইন জার্সি পরা তরুণ দৌড়ে এসে তাঁর হাত বেঁধে সাহায্য করেন। এমন মুহূর্তগুলোই জীবনের এক অমূল্য স্মৃতি হয়ে থেকে যায়।

আটকা পড়া দুই যুবকের ছবি: রায়হান মোল্লা ও অপরজনের সংগ্রামের সাক্ষী

অপরদিকে, পুলিশ গুলির ভয়ে ছড়িয়ে পড়লেও দুইজন আটকা পড়ে যান সড়ক বিভাজকের আড়ালে। পরে জানা যায়, তাঁদের মধ্যে একজনের নাম রায়হান মোল্লা। আহত অবস্থায় তারা সেখান থেকে সরে আসতে পারেননি।

খালেদ তাঁদের ছবি তুলে চলেছেন, যেন সেই মুহূর্তগুলো পৃথিবীর সামনে প্রকাশ পায়।

বিকেলের আরেকটি ছবির গল্প: রাতুলের মর্মান্তিক যাত্রা

দুপুরের পর আন্দোলনকারীরা আবার সড়কে নামেন, মুখোমুখি হন পুলিশের। কাঁদানে গ্যাস শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট আর ছররা গুলির বৃষ্টি হয়।

তখন একটি দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করেন খালেদ, যা পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন ফেলে। লাল টি-শার্ট পরা এক তরুণ পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার জন্য এগিয়ে আসেন, কিন্তু আচমকাই গুলির শিকার হন তিনি।

পরবর্তীতে জানা যায়, ওই তরুণের নাম রাতুল। সেদিন তিনি গুরুতর আহত হন।

প্রতিবাদকে দমন করতে পুলিশের লাঠি, দেশি অস্ত্র ও প্রাণঘাতী বন্দুকের ব্যবহার

সরকারপন্থী গোষ্ঠী এবং পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠি, দেশি অস্ত্র এবং প্রাণঘাতী বন্দুক ব্যবহার করে হামলা চালায়। এমন সময়েও ফটোসাংবাদিকরা ঝুঁকি নিয়ে ছবি তুলেছেন।

একজন হামলাকারী খালেদের ওপর আক্রমণ করে, ফলে তার হাঁটুতেও আঘাত লাগে। তবে তিনি ছুটিতে থাকলেও কাজ থামাননি, ছবি তুলে পাঠাতে পেরেছেন।

ফটোসাংবাদিকদের সাহস ও দায়িত্ব: দেশের হৃদয় স্পর্শ করা ছবি

খালেদ সরকারের এই ছবিগুলো শুধু একটি মুহূর্তের সেলাই নয়, দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতার এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন। এই ছবি তুলে সাংবাদিকতা শুধু তথ্য সরবরাহ নয়, মানুষের চোখ খুলে দেয়, প্রতিবাদের মুখ দেখায়।

শুধু তাই নয়, এই ছবিগুলো অনেকের মন ছুঁয়ে গেছে, জাতির বিবেক জাগিয়ে তুলেছে।

জুলাইয়ের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত: দেশের যুবসমাজের সংগ্রামের গল্প

২০২৫ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের নানা জায়গায় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ এবং আন্দোলনের একটা বড় তরঙ্গ বইছে। শিক্ষার্থীরা এবং সাধারণ মানুষ একযোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক ইস্যু নিয়ে পথে নামছেন।

এসব আন্দোলন সরকারের নীতি ও আচরণ, শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থনৈতিক দুর্দশা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবিতে হচ্ছে। এই আন্দোলনের ছবি এবং ঘটনা দেশের ভবিষ্যতের দিক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

ভাইরাল ছবির পেছনের গল্প: পুলিশের গুলির মাঝেও ফটোসাংবাদিকের সাহসপ্রত্যেক ছবির পেছনে লুকিয়ে থাকে অসংখ্য গল্প

একটি ছবি হাজার কথা বলে। খালেদ সরকারের ছবিগুলোতে লুকিয়ে আছে সেই ভয়ংকর লড়াইয়ের নানান গল্প — আহতদের বেদনা, সংগ্রামীদের দৃঢ়তা, এবং সাংবাদিকতার অনন্য সাহসিকতা।

এই ছবির মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষও আন্দোলনের গুরুত্ব বুঝতে পারছে, প্রতিবাদের মানে এবং তার পেছনের মানবিক কষ্টও উপলব্ধি করছে।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button