নবীজির বাণীতে বদনজরের বাস্তবতা: ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রতিকার

বদনজর: কুপ্রভাব ও বাস্তবতা
বদনজর বা কুদৃষ্টি, যা বাংলায় আমরা ‘খারাপ দৃষ্টি’ বা ‘অশুভ দৃষ্টি’ হিসেবে জানি, ইসলামে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি একধরনের অদৃশ্য প্রভাব যা কোনো মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মানব জীবনে বদনজরের প্রভাব অনেক সময় এতই ভয়াবহ হতে পারে যে, একজনকে উঁচু স্থান থেকে নিচু স্থানে নামিয়ে দিয়ে দুর্ভোগে ফেলে দিতে পারে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “বদনজর সত্য। এটি এমন এক প্রভাব যা মানুষকে উঁচু স্থান থেকে নিচে ফেলে দেয়।” (মুসনাদে আহমাদ: ২৪৭৩)।
সাহাবির জীবনে বদনজরের উদাহরণ
বদনজরের প্রভাবের প্রামাণ্য প্রমাণ আমরা সাহাবিদের জীবনের কিছু ঘটনায় পাই। আবু সাহাল ইবনে হুনাইফ (রা.) একবার গোসল করতে জামা খুলে ফেলেন। তখন আমের ইবনে রবিআ (রা.) তাঁর সুঠাম দেহ দেখে বিস্মিত হয়ে বলেন, “আমি আজ পর্যন্ত এমন সুন্দর দেহ কারও দেখিনি।” এর পর আবু সাহালের শরীরে ভীষণ জ্বর ওঠে।
এই খবর পেয়ে রাসুল (সা.) আমের ইবনে রবিআকে নির্দেশ দেন, অজু করার পর পানি থেকে কিছু অংশ একটি পাত্রে রেখে সেটি আবু সাহালের শরীরে ঢালতে। এতে আবু সাহাল (রা.) অসুস্থতা থেকে মুক্তি পান। এরপর রাসুল (সা.) সতর্ক করে বললেন, “তোমাদের কেউ নিজের ভাইকে কেন হত্যা করতে চায়! যখন তোমার দৃষ্টি তার দেহ সুন্দর দেখেছিল, তখন তুমি তার জন্য বরকতের দোয়া করলে না কেন? বদনজর সত্য।” (মুআত্তা মালেক)
কোরআনে বদনজরের উল্লেখ ও ব্যাখ্যা
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
“কাফেররা যখন উপদেশ শোনে তখন তারা যেন তোমাকে আছড়ে ফেলবে তাদের দৃষ্টি দিয়ে, আর তারা বলে সে তো এক পাগল।” (সুরা কলম: ৫১)
তাফসিরে ইবনে কাসির উল্লেখ করেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, এখানে ‘তাদের দৃষ্টি’ মানে বদনজর। তারা হিংসা ও ঈর্ষার কারণে ক্ষতি করার জন্য এমন দৃষ্টি দেয়, যা মানুষের শরীর ও মনের ওপর প্রভাব ফেলে।
বদনজর থেকে বাঁচার ইসলামিক উপায়
বদনজর থেকে রক্ষা পেতে ইসলামে বেশ কিছু আমল ও দোয়া শেখানো হয়েছে। বিশেষ করে যখন কারো সৌন্দর্য, সম্পদ বা উন্নতি দেখা যায়, তখন তার জন্য মঙ্গলকামনা করে দোয়া করা উচিত। যেমন:
- “বারাকাল্লাহু ফিহি” (আল্লাহ তাআলা এতে বরকত দান করুন)
- অথবা “মাশা আল্লাহ্ লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ”।
বদনজর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ৩টি কার্যকর আমল
১. আয়াতুল কুরসি পড়া: এটি হলো একটি শক্তিশালী আয়াত যা শয়তান ও বদনজরের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে।
২. সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস নিয়মিত পড়া: এই সূরাগুলো বিশেষভাবে রক্ষা প্রদান করে।
৩. শিশুদের জন্য বিশেষ দোয়া: নবী করিম (সা.) ছোটদের কোলে নিয়ে বিভিন্ন দোয়া পড়তেন এবং ফুঁ দিতেন যেন তারা বদনজর থেকে নিরাপদ থাকে।
নবীজির দোয়ায় বদনজর থেকে রক্ষা
নবী করিম (সা.) হজরত হাসান ও হুসাইন (রা.) কে নিম্নলিখিত দোয়াটি পাঠ করে ফুঁ দিতেন:
“উইজুকুমা বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মাতি মিন কুল্লি শাইতানিন ওয়া হাম্মাতিন ওয়া মিন কুল্লি আইনিন লাম্মাতিন।”
অর্থাৎ:
“আমি তোমাদের দু’জনকে আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ কথার আশ্রয়ে রাখতে চাই, সব ধরণের শয়তান, ক্ষতিকর বস্তু এবং বদনজর থেকে।” (সহিহ্ বুখারি)
বদনজরের প্রতিরোধে সচেতনতা জরুরি
সাধারণ জীবনে বদনজর থেকে রক্ষা পেতে আমাদের সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। যাদের সৌন্দর্য, সাফল্য বা সম্পদ বেশি, তাদের প্রতি ঈর্ষুক দৃষ্টিতে তাকানো থেকে বিরত থাকতে হবে। বিপরীতে, তাদের জন্য মঙ্গল কামনা করা এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত।
সাম্প্রতিক গবেষণা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
বর্তমান সময়ে বদনজর নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা হয়েছে যা মানসিক ও সামাজিক প্রভাব তুলে ধরে। বিশেষ করে সমাজে ঈর্ষা ও嫉妒 থেকে সৃষ্ট নেতিবাচক মানসিকতা মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। ইসলামে যা বদনজর হিসেবে বর্ণিত হয়েছে, সেটির আধুনিক বিজ্ঞান ও মনস্তত্ত্বেও মিল পাওয়া যায়।
সারসংক্ষেপ:
- বদনজর সত্য ও প্রভাবশালী একটি ধর্মীয় ও সামাজিক বাস্তবতা।
- নবী করিম (সা.)-এর বাণী ও সাহাবিদের জীবন থেকে বদনজরের প্রমাণ মেলে।
- কোরআন ও হাদিসে বদনজরের উল্লেখ ও তা থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ দোয়া শেখানো হয়েছে।
- ঈর্ষা বা খারাপ দৃষ্টির পরিবর্তে বরকতের দোয়া করা, বদনজর থেকে রক্ষার অন্যতম উপায়।
- আয়াতুল কুরসি ও সুরা ইখলাস, ফালাক, নাস নিয়মিত পাঠ ও দোয়া আমল বিশেষভাবে ফলপ্রসূ।
- সমাজে বদনজরের প্রভাব কমাতে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।