নারী নির্যাতনের মামলায় সংগীতশিল্পী নোবেল গ্রেপ্তার

আলোচিত ও সমালোচিত সংগীতশিল্পী মাইনুল আহসান নোবেল এবার সরাসরি আইনগত জটিলতার মুখে পড়েছেন। নারী নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের করা মামলার ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ডেমরা থানা।
এই ঘটনা বাংলাদেশে বিনোদন অঙ্গন ও সামাজিক মাধ্যমে নতুন করে আলোচনা সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন সময় বিতর্কিত বক্তব্য ও কার্যক্রমের কারণে আলোচনায় থাকা এই গায়কের বিরুদ্ধে এবার আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা সাধারণ মানুষ এবং শিল্পী সমাজে আলোড়ন তুলেছে।
গ্রেপ্তারের তথ্য নিশ্চিত করল ডিএমপি
মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া ও জনসংযোগ বিভাগের উপ-কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে জানান:
“নারী নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের করা মামলার ভিত্তিতে মাইনুল আহসান নোবেলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রাজধানীর ডেমরা থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে।”
তিনি আরও জানান, গ্রেপ্তারের পর নোবেলকে থানায় নেওয়া হয়েছে এবং মামলার আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী তদন্ত ও পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
নোবেল বর্তমানে থানায় হেফাজতে
ডেমরা থানা সূত্রে জানা গেছে, নোবেলকে গ্রেপ্তারের পর সোমবার রাত থেকেই থানার হেফাজতে রাখা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার নথিপত্র যাচাই করে পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
এখনও পর্যন্ত মামলার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ বা বাদীর পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। তবে পুলিশ নিশ্চিত করেছে, মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত) অনুযায়ী তদন্তাধীন।
আগেও বিতর্কে ছিলেন নোবেল
মাইনুল আহসান নোবেল একসময় তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রিয় সংগীতশিল্পী হিসেবে পরিচিতি পান। ২০১৯ সালে ভারতীয় রিয়েলিটি শো “সারেগামাপা”-তে অংশ নিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার আচরণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্কিত মন্তব্য এবং কিছু ঘটনাকে ঘিরে সমালোচনার মুখে পড়েন।
পূর্ববর্তী বিতর্কের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত বিষয়ে আপত্তিকর মন্তব্য
- সহশিল্পীদের নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যপূর্ণ বক্তব্য
- কনসার্টে সময়মতো উপস্থিত না হওয়া ও আচরণগত অভিযোগ
- স্ত্রী প্রীতমা হক-এর সঙ্গে দাম্পত্য কলহ ও গণমাধ্যমে উত্তপ্ত ভাষ্য
২০২১ সালেও প্রীতমা হক একাধিকবার তার বিরুদ্ধে গার্হস্থ্য সহিংসতার অভিযোগ তুলেছিলেন, যদিও সেই সময় কোনো আনুষ্ঠানিক মামলা দায়ের হয়নি।
এইবার অভিযোগ আরও গুরুতর
বর্তমান মামলার বিস্তারিত এখনো প্রকাশ না করা হলেও পুলিশ সূত্রে জানা যাচ্ছে, নারী নির্যাতনের অভিযোগটি মারাত্মক এবং শারীরিক সহিংসতার দিকেই ইঙ্গিত করছে। মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এর আওতায় নেওয়া হয়েছে, যার শাস্তি সাজাপ্রাপ্ত হলে ৩ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
এ ধরনের মামলায় তদন্তকারী সংস্থাকে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার জন্য ৬০ দিনের সময়সীমা নির্ধারিত রয়েছে। এ ছাড়া আসামিকে প্রাথমিক তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আদালতের অনুমতি ছাড়া জামিন দেওয়া হয় না।
আইনজীবীদের অভিমত
ঢাকা জজ কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাহফুজুল আলম বলেন:
“নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতাধীন মামলায় পুলিশ যদি প্রাথমিকভাবে সত্যতা পায়, তাহলে আসামিকে তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার করাই আইনসিদ্ধ। এরপর আদালতের নির্দেশেই পরবর্তী পদক্ষেপ হয়।”
তিনি আরও বলেন, “নোবেলের পরিচিতি যেহেতু জনসম্মুখে রয়েছে, তার ক্ষেত্রে জনস্বার্থের দিকটিও বিবেচনায় নেওয়া হতে পারে। আদালত চাইলে তদন্তকালীন সময়েও তাকে রিমান্ডে নিতে পারে।”
সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও মিডিয়ার আলোড়ন
নোবেল গ্রেপ্তার হওয়ার খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কেউ কেউ পুরনো অভিযোগগুলোর স্মরণ করে বলেন, “অবশেষে তার আসল রূপ প্রকাশ পেল”, অন্যদিকে কেউ কেউ এটিকে “ব্যক্তিগত জীবনের বিষয়” বলে মনে করছেন এবং তার ‘ব্যক্তিগত দুঃখ’ বুঝতে আহ্বান জানাচ্ছেন।
তবে নোবেলের ভক্তদের একটি অংশ এখনও তার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং অভিযোগ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত মন্তব্য থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
সংগীতাঙ্গনে নীরব প্রতিক্রিয়া
সংগীতশিল্পী নোবেল একসময় বাংলাদেশের তরুণ শ্রোতাদের কাছে নতুন এক স্বরূপ এনেছিলেন। কিন্তু একের পর এক বিতর্ক এবং শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে মূলধারার সংগীতজগতে তার অবস্থান ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে।
বর্তমানে তার গ্রেপ্তারের ঘটনায় সংগীতশিল্পী মহলে প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া না এলেও অন্দরমহলে বিস্ময় ও হতাশা বিরাজ করছে বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জনপ্রিয় ব্যান্ডশিল্পী বলেন:
“প্রতিভা থাকলেই সবকিছু হয় না। চরিত্র, শৃঙ্খলা এবং দায়িত্বশীলতা না থাকলে এই অবস্থাই হয়।”
ন্যায়বিচার ও পেশাদারিত্বের প্রত্যাশা
মাইনুল আহসান নোবেলের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা বর্তমানে প্রাথমিক তদন্তাধীন। সমাজে জনপ্রিয় বা পরিচিত ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও কেউ যদি আইনের লঙ্ঘন করে থাকেন, তবে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়াই গণতান্ত্রিক ও ন্যায়সঙ্গত।
আশা করা যায়, তদন্ত সঠিক ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হবে এবং দোষী প্রমাণিত হলে যথাযথ বিচার হবে। একই সঙ্গে, কোনো ব্যক্তি নির্দোষ প্রমাণিত হলে যেন তার সম্মানও ফিরিয়ে দেওয়া হয় — এমনটাই চায় একটি দায়িত্বশীল সমাজ।