বিনোদন

‘আইয়ুব বাচ্চু মিউজিক অ্যাওয়ার্ড’ চালুর প্রস্তাব রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণ করার দাবি

Advertisement

বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, রক জগতের কিংবদন্তি ও গিটারের জাদুকর আইয়ুব বাচ্চু— যিনি শুধু একজন সংগীতশিল্পী নন, ছিলেন এক প্রজন্মের অনুপ্রেরণা। তাঁর স্মৃতিকে স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে এবার প্রস্তাব উঠেছে ‘আইয়ুব বাচ্চু মিউজিক অ্যাওয়ার্ড’ চালুর।

এই প্রস্তাব দিয়েছেন ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্তী, যিনি প্রয়াত এই শিল্পীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।

তিনি বলেন,

“আমার দীর্ঘদিনের ইচ্ছে ছিল বাচ্চু ভাইয়ের নামে একটি জাতীয় সংগীত পুরস্কার দেওয়া হোক। এই ‘আইয়ুব বাচ্চু মিউজিক অ্যাওয়ার্ড’-এর আয়োজনে আমি এবং আমার প্রতিষ্ঠান সবসময় পাশে থাকব।”

রক আইকনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানোর দাবি

আশীষ কুমার আরও বলেন,

“বাচ্চু ভাইয়ের জন্মদিন কিংবা মৃত্যুবার্ষিকী কখনই ছোট পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। রাষ্ট্রের উচিত এই কীর্তিমান শিল্পীর অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং নিয়মিতভাবে তাকে স্মরণ করা।”

২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর এই রকস্টার পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তাঁর চলে যাওয়ায় সংগীতাঙ্গনে তৈরি হয় এক বিশাল শূন্যতা, যা আজও পূরণ হয়নি।

গিটার কিং আইয়ুব বাচ্চুর যাত্রা

১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আইয়ুব বাচ্চু। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল প্রবল। আশির দশকে তিনি ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের সদস্য হিসেবে সংগীতজগতে প্রবেশ করেন, পরে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ড এলআরবি (Love Runs Blind)

চলো বদলে যাই’, ‘বাংলাদেশ’, ‘রূপালি গিটার’, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’— এর মতো অগণিত গান আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে বাজে তাঁর সুরে।


বিজয়ানন্দ’ কনসার্টের স্মৃতি

ডা. আশীষ কুমার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানান, ২০১০ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিজয় দিবসের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘বিজয়ানন্দ’ নামে একটি ওপেন এয়ার কনসার্টের আয়োজন করা হয়।
বাচ্চু ভাই ছিলেন এই কনসার্টের মূল আকর্ষণ।

কিন্তু কনসার্টের দুই দিন আগে বাচ্চু জানালেন, তাঁর আরেকটি প্রোগ্রাম পড়েছে সেই একই দিনে। সব প্রস্তুতি শেষ, প্রচারণা সম্পন্ন— তখন এমন খবর পেয়ে আয়োজকরা হতাশ হয়ে পড়েন।

তবে বাচ্চু ভাইয়ের উত্তর ছিল অবিশ্বাস্য:

“আমি হেলিকপ্টারে করে আসব কনসার্টে। আপনারা কোনো খরচ করবেন না, আমি নিজেই সব দেখব। তবে এক ঘণ্টার বেশি রাখতে পারবেন না— হেলিকপ্টারের ল্যান্ডিং চার্জ বেড়ে যাবে!”

ঠিক এভাবেই তিনি নিজ খরচে হেলিকপ্টারে করে এসে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। আশীষ কুমার বলেন,

“তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি অর্থের বিনিময়ে নয়, ভালোবাসার টানে সংগীত করতেন। তাঁর মতো উদার হৃদয়ের মানুষ খুব কমই দেখা যায়।”

অভিমানী অথচ নিরহংকারী শিল্পী

২০১২ সালে আর্মি স্টেডিয়ামে আয়োজিত “ওল্ড ইজ গোল্ড” কনসার্টের স্মৃতিও তুলে ধরেন আশীষ। সেখানে জেমস ও এলআরবি পারফর্ম করার কথা ছিল। কিন্তু সময়সূচির সামান্য ভুল বোঝাবুঝিতে বাচ্চু ভাই অভিমান করে মঞ্চে উঠছিলেন না।

শেষ পর্যন্ত বাচ্চু ভাইয়ের স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার চন্দনার হস্তক্ষেপে তিনি কনসার্ট শেষ করেন।

“বাচ্চু ভাই ছিলেন শিশুসুলভ, অভিমানী, কিন্তু ভীষণ ভালো মানুষ। তাঁর হৃদয় ছিল অসীম উদারতার সমুদ্র,” — স্মৃতিচারণ করেন আশীষ কুমার।

জাতীয় পর্যায়ে ‘আইয়ুব বাচ্চু মিউজিক অ্যাওয়ার্ড’-এর সম্ভাবনা

‘আইয়ুব বাচ্চু মিউজিক অ্যাওয়ার্ড’ চালু হলে তা হবে দেশের প্রথম রক-সংগীতকেন্দ্রিক পুরস্কার। এ উদ্যোগের মাধ্যমে উদীয়মান সংগীতশিল্পীরা নতুন অনুপ্রেরণা পাবেন, আর আইয়ুব বাচ্চুর স্মৃতি থাকবে জাগরুক।

বিনোদন অঙ্গনের অনেকেই এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। সংগীত পরিচালক ফুয়াদ আল মুক্তাদির বলেন,

“বাচ্চু ভাই শুধু একজন সংগীতশিল্পী ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন স্কুল— তাঁর কাছ থেকে সবাই কিছু না কিছু শিখেছে।”

গায়ক জেমস এক সাক্ষাৎকারে বলেন,

“বাচ্চু আমার ভাইয়ের মতো ছিল। আমরা একসাথে দেশের রক আন্দোলন শুরু করেছি। তাঁর নামে পুরস্কার হলে সেটা হবে আমাদের সবার প্রাপ্তি।”

এলআরবি: ভালোবাসার ব্যান্ড

আইয়ুব বাচ্চু ১৯৯১ সালে গঠন করেন ব্যান্ড এলআরবি। তাদের প্রথম অ্যালবাম ‘এলআরবি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে, যা তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।
ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘সেই তুমি’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘মন চাইলে মন পাবে’— এরকম অসংখ্য গান আজও শ্রোতাদের মন মাতায়।

তাঁর বাজানো গিটার আজও তরুণ প্রজন্মের অনুপ্রেরণা। অনেক সংগীতপ্রেমী এখনো তাঁর ব্যবহৃত রূপালি গিটারকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।

তাঁর বিদায় এবং উত্তরাধিকার

২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর সকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আইয়ুব বাচ্চু চলে যান না ফেরার দেশে। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর খবরে দেশজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া।
তাঁকে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহ আমানত কবরস্থানে দাফন করা হয়।

তবে তাঁর রেখে যাওয়া সুর আজও প্রতিদিন বাজে রেডিও, টেলিভিশন ও শ্রোতাদের হৃদয়ে।

আইয়ুব বাচ্চু মিউজিক অ্যাওয়ার্ড’: কেমন হতে পারে আয়োজনটি

প্রস্তাব অনুযায়ী, এই অ্যাওয়ার্ডে থাকবে কয়েকটি বিভাগ—

  • বর্ষসেরা রক গায়ক/গায়িকা
  • বর্ষসেরা ব্যান্ড পারফরমার
  • সেরা গিটারিস্ট
  • সেরা নতুন শিল্পী
  • আইয়ুব বাচ্চু লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড

পুরস্কারের পাশাপাশি থাকবে বার্ষিক ট্রিবিউট কনসার্ট, যেখানে দেশের বিভিন্ন ব্যান্ড শিল্পীরা তাঁর গান পরিবেশন করবেন।

এছাড়াও পরিকল্পনা রয়েছে “রূপালি গিটার ফাউন্ডেশন” নামে একটি ট্রাস্ট গঠনের, যা তরুণ সংগীতশিল্পীদের সহায়তা করবে— বাদ্যযন্ত্র, প্রশিক্ষণ ও মঞ্চ সুবিধা প্রদানে।

প্রেম, সংগীত ও মানবতার প্রতীক আইয়ুব বাচ্চু

আইয়ুব বাচ্চু শুধু একজন শিল্পী নন, ছিলেন এক প্রজন্মের হৃদস্পন্দন। তিনি বলেছিলেন,

“আমি চাই, আমার গান মানুষকে বাঁচতে শেখাক, ভালোবাসতে শেখাক।”

তাঁর এই দর্শনই আজও জীবন্ত সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে।
যদি ‘আইয়ুব বাচ্চু মিউজিক অ্যাওয়ার্ড’ বাস্তবায়িত হয়, তবে সেটি হবে কেবল একটি পুরস্কার নয়—
এটি হবে বাংলাদেশের সংগীত ইতিহাসে এক অনন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি।

MAH – 13491 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button