হুমায়ূন আহমেদের গল্পে নতুন সিনেমা, পরিচালনায় তানিম নূর
বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন এক আলোচনার জন্ম দিয়েছে হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হতে যাওয়া সিনেমা ‘বনলতা এক্সপ্রেস’। সিনেমাটির পরিচালনায় রয়েছেন তরুণ নির্মাতা তানিম নূর, আর মূল চরিত্রে অভিনয় করছেন মোশাররফ করিম।
দীর্ঘদিন পর আবারও বড় পর্দায় ফিরছেন এই শক্তিমান অভিনেতা, আর তাঁর এই প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে দর্শক-সমালোচকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে তুমুল আগ্রহ।
হুমায়ূন আহমেদের গল্পে নতুন প্রাণ
বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তি নাম হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর লেখার আবেগ, চরিত্রের গভীরতা এবং বাস্তব জীবনের সূক্ষ্মতা পাঠককে বারবার মুগ্ধ করেছে। তাঁর উপন্যাস ‘কিছুক্ষণ’–এর গল্প অবলম্বনে তৈরি হচ্ছে ‘বনলতা এক্সপ্রেস’।
গল্পের মূল সুর মানবমনের জটিলতা, সময় ও সম্পর্কের সূক্ষ্ম রূপান্তর। পরিচালক তানিম নূর জানিয়েছেন, তিনি উপন্যাসটির ভাব বজায় রেখেই একটি আধুনিক ব্যাখ্যা নিয়ে আসছেন, যা নতুন প্রজন্মের দর্শকের কাছেও প্রাসঙ্গিক হবে।
তানিম নূরের ভাষায়—
“হুমায়ূন আহমেদের গল্পে এমন এক চিরন্তন আবেদন আছে, যা সময়ের সঙ্গে মরে যায় না। ‘বনলতা এক্সপ্রেস’-এ আমরা সেই আবেদনকে নতুন ভাষায়, নতুন আঙ্গিকে দর্শকের সামনে তুলে ধরব।”
মোশাররফ করিম: এক চরিত্র, এক বিশ্বাস
‘বনলতা এক্সপ্রেস’-এর অন্যতম আকর্ষণ নিঃসন্দেহে মোশাররফ করিম। নাট্যজগতে তিনি ইতোমধ্যেই এক জীবন্ত কিংবদন্তি। তবে বড় পর্দায় তাঁর উপস্থিতি সবসময়ই বিশেষ কিছু।
সম্প্রতি SignalBD-এর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন—
“বনলতা এক্সপ্রেস নিয়ে তানিম নূরের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি তাঁর ভাবনা পছন্দ করেছি। হুমায়ূন আহমেদের গল্প নিজেই একটা শক্তি। আমি গল্পটা পড়েছি, জানি এটা দারুণ এক উপন্যাস। যদি পরিচালক নিজের ভিশনটা ঠিকমতো রূপ দিতে পারেন, তাহলে এটি অসাধারণ কাজ হবে।”
অভিনেতা আরও বলেন,
“আমি সিনেমা করার সময় পরিচালকের প্রতি বিশ্বাস রাখি। সিনেমা তো কারখানার জিনিস না—এটা একটা মানসিক ও সৃজনশীল খেলা। তানিম নূরের চিন্তা, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে আশাবাদী করেছে।”
চঞ্চল চৌধুরীর সঙ্গে আবার একসঙ্গে
‘বনলতা এক্সপ্রেস’-এর আরেক চমক হল, অনেক দিন পর চঞ্চল চৌধুরী ও মোশাররফ করিমকে একসঙ্গে দেখা যাবে। বাংলা নাটকের এই দুই তারকার যুগলবন্দি দর্শকের কাছে সবসময়ই প্রিয়।
দুজনের রসায়ন, সংলাপের অভিনয়, ও চরিত্রের মধ্যে প্রাণ ঢেলে দেওয়া—সবকিছু মিলিয়ে তাদের উপস্থিতি এক বিশেষ আকর্ষণ তৈরি করে।
মোশাররফ বলেন,
“দর্শক আমাদের একসঙ্গে দেখতে ভালোবাসে, সেটাই আমাদের অনুপ্রেরণা। চঞ্চল ভাইয়ের সঙ্গে কাজ মানে একটা নতুন অভিজ্ঞতা। আশা করছি, এবারও দর্শক হতাশ হবে না।”
তানিম নূর: তরুণ নির্মাতার বড় চ্যালেঞ্জ
তানিম নূর এর আগে নির্মাণ করেছেন জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ ‘বিঞ্জ’ ও ‘মহানগর’-এর কিছু সহযোগী প্রকল্প। তিনি সবসময় গল্পনির্ভর ও চরিত্রকেন্দ্রিক কাজ করতে পছন্দ করেন।
‘বনলতা এক্সপ্রেস’ তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় সিনেমা হতে যাচ্ছে।
তিনি জানান,
“এটা আমার কাছে শুধুই একটা সিনেমা নয়, বরং একধরনের যাত্রা। হুমায়ূন আহমেদের গল্পের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা আছে। আমি চেষ্টা করছি সেই আবহ, সেই আবেগ—সবকিছু আধুনিকভাবে উপস্থাপন করতে।”
চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যে যুক্ত আছেন তরুণ লেখক নাহিদুল ইসলাম। সিনেমার সংগীত পরিচালনা করবেন অরূপ ভট্টাচার্য, যিনি ইতিমধ্যেই বাংলা সিনেমায় নিজস্ব স্বকীয়তা তৈরি করেছেন।
গল্পের ভেতরে মানুষের গল্প
‘বনলতা এক্সপ্রেস’ মূলত এক মনস্তাত্ত্বিক ড্রামা। ট্রেনের মতো চলমান জীবনের প্রতিটি স্টেশনে মানুষের ভেতরের পরিবর্তন, ভালোবাসা, হারানো সময়—সবকিছু মিলেই এর কাহিনি।
হুমায়ূন আহমেদের গল্পে যে ধরনের নিঃশব্দ সংলাপ, চুপচাপ গভীরতা থাকে—সেই অনুভূতিই সিনেমাটিতে রূপ নিতে চলেছে।
চলচ্চিত্র বিশ্লেষকরা মনে করছেন,
“‘বনলতা এক্সপ্রেস’ যদি সঠিকভাবে নির্মিত হয়, তবে এটি হতে পারে বাংলা চলচ্চিত্রে এক নতুন যুগের সূচনা। কারণ, এ ধরনের গল্প শুধু বিনোদন নয়, দর্শকের চিন্তাকেও নাড়া দেয়।”
মহানগর’-এর সাফল্যের পর নতুন প্রত্যাশা
মোশাররফ করিমকে দর্শক সর্বশেষ দেখেছেন আলোচিত ওয়েব সিরিজ ‘মহানগর’–এ। সেখানে ‘ওসি হারুন’ চরিত্রে তাঁর অভিনয় তাকে নতুন প্রজন্মের কাছেও জনপ্রিয় করে তোলে।
‘মহানগর’-এর তৃতীয় সিজন নিয়েও চলছে আলোচনা। এ বিষয়ে তিনি বলেন,
“ওসি হারুনকে আবার কবে দেখা যাবে, এটা ভালো বলতে পারবে পরিচালক আশফাক নিপুন। তবে মহানগর-৩ নিয়ে কিছু আলোচনা চলছে, সেটাই বলতে পারি।”
এবারের ‘বনলতা এক্সপ্রেস’ সিনেমাটি তাঁর ক্যারিয়ারের আরেক বড় মাইলফলক হতে পারে—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলা চলচ্চিত্রে সাহিত্যনির্ভর সিনেমার নবজাগরণ
বাংলা চলচ্চিত্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাহিত্যের গল্প অবলম্বনে নির্মাণের প্রবণতা বেড়েছে। ‘হীরক রাজা দেশের মানুষ’, ‘দেবদাস’, ‘বিসর্জন’, ‘দহন’, ‘দ্য ওয়াচ’-এর মতো সিনেমাগুলো প্রমাণ করেছে—সাহিত্য আর সিনেমার মেলবন্ধন সবসময় দর্শকের হৃদয় ছোঁয়।
‘বনলতা এক্সপ্রেস’ সেই ধারারই একটি নতুন সংযোজন।
দর্শকেরা বলছেন,
“হুমায়ূন আহমেদের গল্প মানেই একধরনের নস্টালজিয়া, এক আবেগ। মোশাররফ করিমের মতো অভিনেতা থাকলে সেই গল্প আরও বাস্তব হয়ে ওঠে।”
প্রযোজনা, মুক্তির পরিকল্পনা ও প্রত্যাশা
জানা গেছে, ‘বনলতা এক্সপ্রেস’ প্রযোজনা করছে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট স্টুডিও। ছবির শুটিং শুরু হবে ২০২৫ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে।
শুটিং হবে ঢাকাসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন মনোরম স্থানে। ট্রেনভিত্তিক গল্প হওয়ায় বাংলাদেশ রেলওয়ের সহযোগিতাও নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রযোজক।
চলচ্চিত্রটি ২০২৬ সালের ঈদুল ফিতর উপলক্ষে মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে,
“আমরা চাই দর্শক যেন আবারও বড় পর্দায় গল্পের শক্তি অনুভব করতে পারে। ‘বনলতা এক্সপ্রেস’ হবে সেই প্রত্যাবর্তনের সুর।”
মোশাররফ করিমের প্রত্যাশা: “সিনেমা মানে দায়িত্ব”
সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে মোশাররফ করিম বলেন,
“আমি কখনো সিনেমাকে শুধুমাত্র অভিনয় হিসেবে দেখি না। এটা একটা দায়িত্ব। কারণ একজন অভিনেতার অভিনয়ের ভেতর দিয়ে দর্শক সমাজ, সম্পর্ক, মানবিকতা সব কিছুই দেখে। ‘বনলতা এক্সপ্রেস’-এ সেই দায়িত্ববোধটাই আমাকে টানে।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“আমি চাই, এই সিনেমা মানুষকে কিছু সময়ের জন্য থামিয়ে দিক—নিজের জীবনটা একটু ভাবুক, যেমন হুমায়ূন আহমেদের লেখায় হয়।”
দর্শকের প্রত্যাশা
সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতিমধ্যেই সিনেমাটি নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে।
ফেসবুক, এক্স (টুইটার) এবং ইউটিউবে ভক্তরা লিখছেন—
“মোশাররফ করিম আর চঞ্চল চৌধুরী একসঙ্গে মানেই ম্যাজিক।”
“হুমায়ূন আহমেদের গল্পে সিনেমা মানেই শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর নস্টালজিয়া।”
বাংলা সিনেমার দর্শক আজ নতুন এক যাত্রার অপেক্ষায়—
‘বনলতা এক্সপ্রেস’-এর সেই ট্রেনে সবাই উঠতে চায়, এক টুকরো গল্প, একটুখানি আবেগ খুঁজে পেতে।
‘বনলতা এক্সপ্রেস’ শুধুমাত্র একটি সিনেমা নয়—এটি এক নতুন যুগের প্রতিশ্রুতি।
হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যভুবন থেকে উঠে আসা এই গল্পে জীবনের জটিলতা, ভালোবাসা আর মানবিকতার সংমিশ্রণ ঘটবে আধুনিক সিনেমাটিক ভাষায়।
মোশাররফ করিমের অভিনয়, তানিম নূরের নির্মাণ, আর চঞ্চল চৌধুরীর উপস্থিতি—সব মিলিয়ে দর্শকের কাছে এটি হতে পারে বাংলা চলচ্চিত্রের এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
MAH – 13458 I Signalbd.com



