ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ১৮০০ শিল্পীর সাংস্কৃতিক বয়কট

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় টানা দুই বছরের রক্তাক্ত আগ্রাসন, নির্বিচারে বোমা বর্ষণ এবং হত্যাযজ্ঞে প্রাণ হারিয়েছেন ৬৪ হাজারেরও বেশি মানুষ। শিশু, নারী, বৃদ্ধ—কারও জীবন রক্ষা পায়নি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও বিশ্ব জনমত ইসরায়েলের এই আগ্রাসন থামাতে বারবার আহ্বান জানালেও দখলদার বাহিনী তাতে কর্ণপাত করেনি।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রতিবাদে দাঁড়িয়ে গেলেন বিশ্বের নামকরা শিল্পীরা। হলিউড থেকে ইউরোপ, এশিয়া থেকে আফ্রিকা—সব মহাদেশের প্রায় ১,৮০০ শিল্পী একযোগে ঘোষণা করেছেন, তারা আর ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সাংস্কৃতিক বা চলচ্চিত্র-সম্পর্কিত কাজে অংশ নেবেন না।
শিল্পীদের যৌথ বিবৃতি
‘ফিল্ম ওয়ার্কার্স ফর প্যালেস্টাইন’ নামের সংগঠনটির পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে—
“এমন সময়ে যখন অনেক সরকার গণহত্যাকে নীরবে সমর্থন করে যাচ্ছে, তখন শিল্পী সমাজের দায়িত্ব হলো ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো। ইসরায়েলি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, পরিবেশক কিংবা বিক্রয় এজেন্টরা কখনো ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকারের পাশে দাঁড়ায়নি। তাই আমরা ঘোষণা দিচ্ছি, ইসরায়েলের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে কোনো ধরনের সহযোগিতায় অংশ নেব না।”
বড় উৎসবগুলোতে থাকবে না বিশ্ব তারকারা
এই সিদ্ধান্তের ফলে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসবগুলো বড় ধাক্কা খেতে যাচ্ছে।
এর মধ্যে রয়েছে:
- জেরুজালেম ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল
- হাইফা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল
- ডোকাভিভ (Docaviv)
- তেলআবিব ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল
- টিএলভি ফেস্ট (TLVFest)
আগামী বছরগুলোতে এসব আসরে অংশ নেবেন না তারকারা, প্রদর্শিত হবে না তাদের সিনেমা। ফলে ইসরায়েলের চলচ্চিত্রশিল্প আন্তর্জাতিক মঞ্চে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তারকাদের তালিকায় কারা আছেন
বয়কটের ডাক দেওয়া শিল্পীদের তালিকা অত্যন্ত দীর্ঘ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলিউড তারকারা হলেন:
- এমা স্টোন
- অলিভিয়া কোলম্যান
- আয়ো এডিবেরি
- লিলি গ্ল্যাডস্টোন
- মার্ক রাফেলো
- হান্না আইনবাইন্ডার
- পিটার সারসগার্ড
- আইমি লু উড
- পাপা এসিডু
- গ্যয়েল গার্সিয়া বার্নাল
- রিজ আহমেদ
- মেলিসা বারেরা
- সিনথিয়া নিক্সন
- টিল্ডা সুইনটন
- জেভিয়ার বারডেম
- জো অ্যালউইন
- জশ ও’কনর
এছাড়া খ্যাতিমান নির্মাতাদের মধ্যে রয়েছেন:
- ইয়র্গোস ল্যান্থিমোস (পুরস্কারজয়ী নির্মাতা)
- আভা ডুভার্নে
- অ্যাডাম ম্যাককে
- বুটস রিলে
- এমা সেলিগম্যান
- জোশুয়া ওপেনহাইমার
- মাইক লেই
এমন শক্তিশালী নামগুলোর উপস্থিতি এই আন্দোলনকে শুধু সাংস্কৃতিক নয়, বরং রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থান হিসেবেও আরও দৃঢ় করেছে।
কেন এই বয়কট গুরুত্বপূর্ণ?
বিশ্বজুড়ে সাংস্কৃতিক বয়কট একটি পরীক্ষিত প্রতিবাদ কৌশল। এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার এপারথেইড শাসনের সময়ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক বয়কট ছিল সেই অন্যায় ব্যবস্থাকে ভেঙে দেওয়ার অন্যতম চালিকা শক্তি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ফিলিস্তিনের জন্য এবারকার এই আন্দোলন দক্ষিণ আফ্রিকার বয়কটের মতোই একটি ঐতিহাসিক মোড় হতে পারে। যখন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ কার্যকর হয় না, তখন সংস্কৃতি ও কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করাই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
ইসরায়েলের অবস্থান
অন্যদিকে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ অবশ্য দাবি করছে—এটি ‘শিল্পকে রাজনীতির হাতিয়ার’ বানানোর চেষ্টা। দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “সিনেমা হলো মানুষের আবেগ ও গল্প বলার জায়গা। এটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা দুঃখজনক।” তবে সমালোচকদের মতে, ফিলিস্তিনে চলমান হত্যাযজ্ঞের দায় এড়ানোর জন্যই ইসরায়েল এভাবে কথা বলছে।
ফিলিস্তিনের প্রতিক্রিয়া
ফিলিস্তিনের সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই ঘোষণা স্বাগত জানিয়েছে। তাদের মতে, এটি আন্তর্জাতিক জনমতকে আরও শক্তিশালী করবে এবং দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চাপ বাড়াবে। গাজা ও পশ্চিম তীরে বহু শিল্পী ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক সহকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া
ঘোষণার পরপরই সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনা। #ArtistsForPalestine, #CulturalBoycott, #FreePalestine—এই হ্যাশট্যাগগুলো দ্রুত ট্রেন্ডিংয়ে চলে আসে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন।
ভবিষ্যতের প্রভাব
এই বয়কট দীর্ঘমেয়াদে ইসরায়েলের চলচ্চিত্র শিল্পে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। আন্তর্জাতিক উৎসবে সিনেমা প্রদর্শন না হলে বিদেশি অর্থায়ন ও বিতরণ চুক্তি কমে যাবে। পাশাপাশি, ইসরায়েলের ‘সফট পাওয়ার’ বা সাংস্কৃতিক প্রভাবও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিশ্বের নামকরা শিল্পীদের এই সিদ্ধান্ত কেবল একটি শিল্প-সংক্রান্ত ঘোষণা নয়; এটি মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো এক সাহসী পদক্ষেপ। যখন বিশ্ব রাজনীতি প্রায়ই নীরব থাকে, তখন সংস্কৃতির মানুষরা তাদের কণ্ঠ তুলেছেন ফিলিস্তিনের পাশে।
এ আন্দোলন কতটা কার্যকর হবে তা সময়ই বলে দেবে, তবে নিশ্চিতভাবেই এটি ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক একতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
MAH – 12740, Signalbd.com