
বিশ্ব রাজনীতির নতুন এক বিতর্কিত পর্ব শুরু হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা ‘দখল’ ও অঞ্চলটিকে বিলাসবহুল ‘রিভেরা’ রূপান্তরের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের প্রতিষ্ঠান সক্রিয়ভাবে কাজ করছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এটি শুধু মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির জন্য নয়, সামগ্রিক আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও মানবাধিকারকে নিয়েও প্রশ্ন তোলে।
গাজা রিভেরা: ট্রাম্পের ‘স্বপ্ন’ ও বাস্তবতার খেলা
গত কয়েক বছরে মার্কিন রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচিত ছিল গাজার ‘রিভেরা’ পরিকল্পনা। যেখানে গাজাকে পর্যটন, বিনোদন ও শিল্পাঞ্চল বানিয়ে ‘নতুন রিভেরা’ হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এই স্বপ্নটি বাস্তবায়নের জন্য মার্কিন পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ (বিসিজি) কাজ করছে। তবে এবার জানা গেল, ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের প্রতিষ্ঠিত ‘টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জ’ (টিবিআই) এই প্রকল্পে অংশ নিয়েছে।
টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউটের জড়িত হওয়ার অভিযোগ ও প্রতিক্রিয়া
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউট গাজায় যুদ্ধোত্তর পরিকল্পনায় বিসিজির সঙ্গে কাজ করেছে। যেখানে গাজার ‘ট্রাম্প রিভেরা’ নামে বিলাসবহুল রিসোর্ট তৈরির কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ইলন মাস্কের নামে একটি আধুনিক শিল্পাঞ্চল গড়ার প্রস্তাবও রয়েছে।
এই প্রকল্প ইসরায়েলি ব্যবসায়ীদের নেতৃত্বে তৈরি এবং বিসিজির অর্থনৈতিক মডেল অনুসরণ করে। তবে টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউট দাবি করেছে, তারা প্রকল্পের মূল অংশে জড়িত ছিল না, শুধু শুরুতে আলোচনায় দুই কর্মী অংশ নিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, গাজাবাসীকে বিতাড়নের কোনো পরিকল্পনায় তারা যুক্ত নয়।
গাজা ইকোনমিক ব্লুপ্রিন্ট ও ‘গ্রেট ট্রাস্ট’ পরিকল্পনা
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলি ব্যবসায়ীরা বিসিজির অর্থনৈতিক মডেল ব্যবহার করে একটি ‘গাজা ইকোনমিক ব্লুপ্রিন্ট’ তৈরি করেছিলেন। এতে গাজার অর্ধমিলিয়ন মানুষকে এলাকা ছেড়ে যেতে রাজি করানোর প্রস্তাব ছিল। এই ‘গ্রেট ট্রাস্ট’ নামক পরিকল্পনা পরে ট্রাম্প প্রশাসনেও পাঠানো হয়। পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য ছিল, গাজায় বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং ধনী উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর নজরকাড়া।
এই নথিতে মোট ১০টি ‘মেগা প্রকল্প’ অন্তর্ভুক্ত ছিল, যার মধ্যে ছিল সৌদি আরবের ‘এমবিএস রিং’ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ‘এমবিজেড সেন্ট্রাল’ হাইওয়ে। এছাড়া ছিল ‘ইলন মাস্ক স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং জোন’ নামক একটি অত্যাধুনিক শিল্প অঞ্চল নির্মাণের পরিকল্পনাও।
টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউটের স্পষ্ট ব্যাখ্যা
টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউটের মুখপাত্র স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, তারা ওই ‘স্লাইড’ তৈরিতে জড়িত ছিল না। তারা বলেছে, ‘স্লাইডটি বিসিজির তৈরি এবং টিবিআই এর সঙ্গে এর কোনো সংযোগ নেই।’ মুখপাত্র আরও জানান, ‘টনি ব্লেয়ার নিজে কখনো এই পরিকল্পনার স্রষ্টাদের সঙ্গে কথা বলেননি বা মন্তব্য করেননি।’
টিবিআইয়ের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়েছে, তারা গাজাবাসীর নিরাপদে গাজায় থাকা এবং শান্তিতে বসবাস নিশ্চিত করায় বিশ্বাসী। গাজা থেকে বিতাড়নের কোনো পরিকল্পনা তাদের নয়। ইনস্টিটিউটের তৈরি ডকুমেন্টগুলো ছিল যুদ্ধ-পরবর্তী বিভিন্ন প্রস্তাব বিশ্লেষণের অভ্যন্তরীণ নথি মাত্র।
টনি ব্লেয়ারের মধ্যপ্রাচ্যে ভূমিকা
টনি ব্লেয়ার দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি প্রায় আট বছর ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি চুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক কোয়ার্টেটের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৫ সালে তিনি ওই পদ থেকে সরে আসেন।
তার ইনস্টিটিউট বর্তমানে ৪৫টিরও বেশি দেশে ৯০০ জনের বেশি কর্মী নিয়ে কাজ করছে। এই প্রতিষ্ঠান দীর্ঘমেয়াদী শান্তি, স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিবেদিত।
বিতর্ক: গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন ও বিসিজি
অন্যদিকে, গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন নামে এক বিতর্কিত ত্রাণ সংস্থার সঙ্গে বিসিজির পুরনো সম্পর্ক নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। গত মাসে বিসিজি জানিয়েছে, তারা ওই ত্রাণ সংস্থার সঙ্গে তাদের চুক্তি বাতিল করেছে। এই ঘটনার পটভূমিতে ট্রাম্পের ‘গাজা রিভেরা’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে আরও সন্দেহ ও প্রশ্ন উঠেছে।
সার্বিক প্রেক্ষাপট: গাজা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি
গাজা এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য সংকট ও সঙ্কটের স্থান। দীর্ঘদিনের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষ, অবরোধ ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে এখানে জনজীবন দুর্বিষহ। মার্কিন ও পশ্চিমা বিশ্বশক্তির উদ্যোগে গাজায় বিনিয়োগ ও উন্নয়নের পরিকল্পনা আসলেও স্থানীয় মানুষের অধিকারের প্রশ্ন উত্থিত হচ্ছে।
গাজার ‘রিভেরা’ নির্মাণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের আড়ালে একটি বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রকল্প। এর প্রভাব শুধু ভূরাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়, মানুষের অধিকার, বাস্তবিক বসবাস ও জাতিগত সংঘর্ষে জড়িত।
গাজার ভবিষ্যৎ ও আন্তর্জাতিক দায়িত্ব
গাজা অঞ্চলের পুনর্গঠন ও উন্নয়ন একটি যুগান্তকারী কাজ। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় স্থানীয় মানুষের মতামত ও অধিকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেতে হবে। টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউটসহ যেসব প্রতিষ্ঠান এই অঞ্চলে কাজ করছে, তাদের দায়িত্ববোধ ও মানবিক মূল্যবোধই প্রকৃত শান্তি ও স্থিতিশীলতার চাবিকাঠি হতে পারে।
‘ট্রাম্প রিভেরা’ প্রকল্প শুধু বিলাসবহুল অবকাঠামো গড়ার প্রস্তাব নয়, এটি গাজার জনজীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হওয়া উচিত। বিশ্ববাসী আশাবাদী, যেখানে মানবিক উন্নয়ন, শান্তি ও ন্যায় নিশ্চিত করা হবে, সেখানে গাজার সোনালী ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে।