যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থী ভিসার সাক্ষাৎকার অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত

যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীদের ভিসা আবেদন প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এখন থেকে শিক্ষার্থী ভিসা (F ও J ক্যাটাগরি) আবেদনকারীদের সাক্ষাৎকারের জন্য নতুন করে আর কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নির্ধারণ করা হবে না। এই স্থগিতাদেশ ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত’ বহাল থাকবে।
সেইসঙ্গে শিক্ষার্থী ভিসার প্রক্রিয়ায় নতুন করে কড়াকড়ি আরোপের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। আবেদনকারীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কার্যক্রম এখন থেকে অধিকতর খুঁটিয়ে খতিয়ে দেখা হবে। এই দুই পদক্ষেপ ইতোমধ্যে মার্কিন ও আন্তর্জাতিক শিক্ষা মহলে ব্যাপক উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
❝ শিক্ষার্থী ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল, বিদ্যমান অ্যাপয়েন্টমেন্ট বহাল ❞
বিবিসির সহযোগী মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিবিএস নিউজ-এর বরাতে জানা গেছে, গতকাল মঙ্গলবার (২৭ মে) পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বিশ্বজুড়ে মার্কিন দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলোতে একটি কূটনৈতিক স্মারক পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, যেসব আবেদনকারীর এখনো সাক্ষাৎকারের তারিখ নির্ধারিত হয়নি, তাঁদের আবেদন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যালেন্ডার থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
তবে যেসব আবেদনকারীর সাক্ষাৎকার আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল, তাঁরা নির্ধারিত সময়েই দূতাবাসে গিয়ে সাক্ষাৎকার দিতে পারবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও স্মারকে বলেন, “এই স্থগিতাদেশ নতুন নির্দেশ না আসা পর্যন্ত বহাল থাকবে।”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারির বিস্তৃতি
স্মারকে আরও বলা হয়েছে, শিক্ষার্থী ও বৈদেশিক বিনিময় কর্মসূচির আওতাধীন ভিসা আবেদনকারীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি বাড়ানো হবে। এতে প্রতিটি দূতাবাস ও কনস্যুলেটের ওপর অতিরিক্ত প্রশাসনিক চাপ পড়বে বলে মনে করছে দপ্তরটি।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নজর রাখছি কে আমাদের দেশে প্রবেশ করছে। এটি আমাদের নিরাপত্তার প্রশ্ন এবং আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে দ্বন্দ্বের পটভূমি
এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময় এলো, যখন ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ত হয়ে উঠছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বারবার অভিযোগ করে আসছেন, হার্ভার্ড ও ইয়েলসহ নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অতিরিক্ত ‘বামপন্থী’ হয়ে উঠেছে এবং সেখানে ইহুদিবিদ্বেষের প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে বৈষম্যমূলক ভর্তি নীতির অভিযোগও তুলেছেন তিনি।
গত সপ্তাহে প্রশাসন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি এবং গবেষক আমন্ত্রণের অনুমোদন বাতিল করে দেয়। তবে একজন ফেডারেল বিচারক সে পদক্ষেপ স্থগিত করেছেন।
ট্রাম্প প্রশাসন এমনকি হার্ভার্ডের কর-ছাড় সুবিধা বাতিল ও তহবিল বন্ধ করার হুমকিও দিয়েছে। এসব পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে একাধিক বিক্ষোভ এবং আইনি লড়াই শুরু হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য অর্থনৈতিক ধাক্কা
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো, তাদের বড় একটি অর্থনৈতিক অংশ নির্ভর করে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ওপর। কারণ, এরা স্থানীয়দের তুলনায় অনেক বেশি টিউশন ফি প্রদান করে। যেমন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থীদের এক-চতুর্থাংশই বিদেশি।
তাই এই ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্ট স্থগিতাদেশ কার্যকর থাকলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
প্রশাসনের কঠোর নীতির ধারাবাহিকতা
ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রশাসন অভিবাসন ও শিক্ষার্থী নীতিতে একের পর এক কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- শত শত মিলিয়ন ডলারের গবেষণা তহবিল স্থগিত
- হাজার হাজার ভিসা বাতিল
- ক্লাস না করলে শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিলের হুমকি
- ‘ফিলিস্তিনপন্থী কার্যকলাপে’ যুক্ত থাকার অভিযোগে ক্যাম্পাসগুলোর নজরদারি
হোয়াইট হাউস এক বিবৃতিতে বলেছে, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ‘ফিলিস্তিনপন্থী কার্যকলাপের নামে ইহুদিবিদ্বেষকে’ প্রশ্রয় দিচ্ছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, এসব পদক্ষেপ শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ প্রভাব
এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, চীন ও আফ্রিকার শিক্ষার্থীরা, যাদের অনেকে এখনো ভিসা সাক্ষাৎকারের অপেক্ষায় আছেন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শিক্ষা সংগঠনগুলো জানিয়েছে, এর ফলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভরসা কমবে এবং বিকল্প হিসেবে কানাডা, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াকে বেছে নিতে পারে অনেকেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে মার্কিন উচ্চশিক্ষার যে ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ ছিল, তা এখন মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে।
সংক্ষেপে মূল বিষয়গুলো:
- মার্কিন দূতাবাসগুলোতে শিক্ষার্থী ভিসার নতুন অ্যাপয়েন্টমেন্ট স্থগিত
- আগে নির্ধারিত সাক্ষাৎকার বহাল
- আবেদনকারীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি বাড়ানো হবে
- হার্ভার্ডসহ শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে প্রশাসনের দ্বন্দ্ব গভীর
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়নে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভূমিকা বিপন্ন
- বিকল্প হিসেবে অন্য দেশগুলোতে ঝুঁকছে শিক্ষার্থীরা
যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের স্বপ্ন দেখেন বিশ্বের লাখ লাখ শিক্ষার্থী। ট্রাম্প প্রশাসনের এই পদক্ষেপ শুধু তাদের স্বপ্নেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও বৈশ্বিক ইমেজেও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, এই স্থগিতাদেশ কতদিন বহাল থাকবে এবং ভবিষ্যতে শিক্ষার্থী ভিসানীতিতে আর কী পরিবর্তন আসছে—বিশ্বজুড়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নজর এখন সেদিকেই।