জাতীয় পাঠ্যক্রম এবং ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সেরা শিক্ষার্থীদের স্বীকৃতি দিল ব্রিটিশ কাউন্সিল

বাংলাদেশে শীতল বিকেল তার আবাহনের আভাস নিয়ে এসেছে; ঢাকার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটরিয়ামে গত ২৪ মে জমকালো আয়োজনে বসেছিল ‘ফেমল্যাব সায়েন্স কমিউনিকেটরস প্রতিযোগিতা–২০২৫’ এর আঞ্চলিক রাউন্ড; আর পরের দিন, ২৫ মে বিকেলে ব্রিটিশ কাউন্সিল, ফুলার রোড অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় ইংরেজি বক্তৃতা প্রতিযোগিতা। দুইদিনব্যাপী এই উৎসবে জাতীয় পাঠ্যক্রম (ইতিমধ্যে স্থানীয় মাধ্যম) ও ইংরেজি মাধ্যম দুই ক্ষেত্রের নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির সেরা ১০০+ শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে শিল্প, বিজ্ঞান ও ভাষার মাধুর্যে নিজেদের দক্ষতা উপস্থাপন করেন।
এই দুই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শুধু সাফল্য উদযাপন নয়, বরং তরুণ প্রতিভাদের আত্মবিশ্বাসী, সৃজনশীল ও পরিষ্কার যোগাযোগদক্ষতা গড়ে তোলার এক অনন্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি হলো। শিল্প–বিজ্ঞান–ভাষার মেলবন্ধনে যুক্ত হলো এক ভিন্ন মাত্রার শিক্ষানুষ্ঠানিক উদযাপন।
ফেমল্যাব সায়েন্স কমিউনিকেটরস: বৈশ্বিক মঞ্চে বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর
ফেমল্যাব (FameLab) হলো ২০০৫ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিল ও চেলটনহাম সায়েন্স ফেস্টিভ্যালের যৌথ প্রযোজনায় শুরু হওয়া আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানযোগাযোগ প্রতিযোগিতা, যা বর্তমানে ৩০+ দেশে আয়োজিত হয়ে অডিও-ভিজ্যুয়াল, প্রেজেন্টেশন ও কথনশৈলীর মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক ধারণা সরল, মনোজ্ঞ এবং আকর্ষণীয় করে উপস্থাপনের সুযোগ দেয়। বাংলাদেশে ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘Science Communicators Hub’ অংশীদারিত্বে প্রথমবারের মতো আঞ্চলিক রাউন্ড থেকে জাতীয় ফাইনাল পর্বে গড়ে উঠেছে এক সুসংগঠিত কাঠামো।
- আঞ্চলিক রাউন্ড: নবম-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ৫ মিনিটের বর্ণনামূলক প্রেজেন্টেশনে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ধারণা উপস্থাপন করেন।
- মাস্টারক্লাস: যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞান উপস্থাপক ও গিনেস রেকর্ডধারী জ্যাগলার ড. কেনেথ ডগলাস ফারকুহারের নেতৃত্বে দুইদিনব্যাপী সেশন, যেখানে শিক্ষার্থীরা শিখেছেন কিভাবে জটিল বিষয়গুলো সহজ, সৃজনশীল ও মনোমুগ্ধকর ভাষায় পরিবেশন করবেন।
- জাতীয় ফাইনাল: আঞ্চলিক পর্যায় থেকে বাছাইকৃত ১০ জন প্রতিযোগী ঢাকায় গিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে অংশ নেন।
এবারের প্রতিযোগিতার বিজয়ী হয়েছেন গ্রেস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল-এর এলাইজা গ্রিন, যিনি তাঁর উপস্থাপনায় “জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ” বিষয়ে মনোগ্রাহী ভাষায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দায়িত্ববোধ তুলে ধরেন। তাঁর সঙ্গে রানার্স-আপ স্থান অর্জন করেছেন ঢাকা পাবলিক স্কুল-এর সামিমা ইসলাম, যিনি “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” বিষয়কে সহজভাবে বুঝিয়ে উপস্থিত হয়েছেন।
ইংরেজি বক্তৃতা প্রতিযোগিতা: Agami প্রজেক্টের এক নতুন অধ্যায়
ব্রিটিশ কাউন্সিলের IELTS বেনার এর অধীনে, ব্র্যাক ব্যাংকের “Agami” উদ্যোগের সঙ্গে অংশীদারিত্বে আয়োজিত ইংরেজি বক্তৃতা প্রতিযোগিতা ২০২৫–এ ৫টি বিভাগ থেকে ৩৩টি স্কুলের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। প্রাথমিক, আঞ্চলিক ও জাতীয়—মোট তিন পর্বে আয়োজিত এই আয়োজন নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল।
প্রতিযোগিতার ধাপসমূহ:
- প্রাথমিক রাউন্ড: বিদ্যালয়ভিত্তিক নির্বাচন, যেখানে শিক্ষার্থীরা মনোনীত টপিক নিয়ে ৩-৫ মিনিটের বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
- আঞ্চলিক রাউন্ড: বিভাগীয় স্তরে নির্বাচিত বাছাই, ভাষার স্বচ্ছতা, বক্তব্যের কাঠামো ও সময়ানুবর্তিতা যাচাই।
- জাতীয় ফাইনাল: সফল ফাইনালিস্টরা সরাসরি ব্রিটিশ কাউন্সিলের অডিটরিয়ামে উঠে বিচারকদের প্যানেল ও লাইভ দর্শকের সামনে তাদের আত্মপ্রকাশ ঘটান।
এবারের গ্রুপ-এ (নবম-দশম শ্রেণি) বিজয়ী হয়েছেন নেভি অ্যাঙ্করেজ স্কুল অ্যান্ড কলেজের লাইবা মুনতাহা, আর গ্রুপ-বি (একাদশ-দ্বাদশ) বিভাগে শিরোপা জেতেন হালিশহর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের আর্ণ নাফি। তাঁদের বক্তৃতায় ইংরেজি ভাষার সাবলীলতা, নেতৃত্বগত পরিবর্তন আবেদন এবং পাবলিক স্পিকিং দক্ষতার এক নতুন মাত্রা ফুটে ওঠে।
প্রধান অতিথি ও আয়োজকদের বক্তব্য
ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশের কান্ট্রি এক্সাম ডিরেক্টর ম্যাক্সিম রাইম্যান বলেন,
“এই ধরনের প্রতিযোগিতাগুলো শুধু শিক্ষার্থীদের শ্রেষ্ঠত্ব উদযাপন করে না, বরং তাদের আত্মবিশ্বাস ও সৃজনশীল চিন্তার প্রসার ঘটাতে সহায়তা করে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ভাষার মিশেলে তরুণ প্রজন্মের যোগাযোগদক্ষতা বিকাশের সুযোগ দিচ্ছে ব্রিটিশ কাউন্সিল।”
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের Science Communicators Hub এর কো-অর্ডিনেটর ড. মলয় ঘোষ যোগ করেন,
“বিজ্ঞান শুধু ল্যাবরেটরির মধ্যে আটকে থাকছে না; ফেমল্যাবের মতো মঞ্চে এসে তা জীবন্ত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানের উপস্থাপনার মাধ্যমে গ্লোবাল অডিয়েন্সের মন জয় করতে পারছে।”
শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা ও প্রতিক্রিয়া
এলাইজা গ্রিন (গ্রেস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল):
“মাস্টারক্লাসে শেখানো কৌশলগুলো কাজে লাগিয়ে আমি আমার গবেষণার থিম অন্যদের সামনে এত সহজভাবে তুলে ধরতে পেরেছি, যা আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়েছে।”
লাইবা মুনতাহা (নেভি অ্যাঙ্করেজ স্কুল):
“ইংরেজি বক্তৃতা তৈরির আগে اض রিসার্চ, স্ক্রিপ্ট রাইটিং আর রিহার্সাল—সবকিছুই একসঙ্গে মেশাতে হয়েছে। ফাইনালে দাঁড়িয়ে সেই অভিজ্ঞতা আমার জীবনের এক স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থাকবে।”
বাংলাদেশের এভেনিউ: ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
- বিজ্ঞানযোগাযোগের গুরুত্ব: দ্রুত পরিবর্তনশীল জ্ঞানভিত্তিক বিশ্বে জটিল ধারণা সহজ ও আকর্ষণীয় মাধ্যমে উপস্থাপন শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও উদ্ভাবনী মনোভাবকে উৎসাহিত করে।
- ইংরেজি দক্ষতা: গ্লোবাল কর্পোরেট, একাডেমিক অথবা গবেষণা ক্ষেত্র—যেখানে একই মঞ্চে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ দক্ষতা অপরিহার্য।
- স্টেকহোল্ডার সমন্বয়: সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক অর্গানাইজেশনের সমন্বিত উদ্যোগ শিক্ষার্থীদের পূর্ণাঙ্গ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে।
- অভিজ্ঞতা সঞ্চার: দেশে আরও বিভিন্ন স্তরে এই ধরনের প্রতিযোগিতা সম্প্রসারণ করলে শিক্ষার্থীদের স্বপ্নদ্যুতি আরও প্রসারিত হবে।
তবে অবকাঠামোগত সাপোর্ট, প্রশিক্ষণগুলোর মান এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের অংশগ্রহণ—এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই বাংলাদেশের তরুণরা গ্লোবাল অডিয়েন্সের দৃষ্টিতে সাফল্য বয়ে আনবে।
ব্রিটিশ কাউন্সিল ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে অগ্রসর ফেমল্যাব সায়েন্স কমিউনিকেটরস এবং ইংরেজি বক্তৃতা প্রতিযোগিতা শুধুমাত্র একটি ইভেন্ট ছিল না; এটি ছিল এক ভিশন—বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে গ্লোবাল মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করার দৃঢ় ইচ্ছা ও সামর্থ্যের প্রমাণ। আগামী দিনে এই উদ্ভাবনী প্রতিযোগিতাগুলো তরুণদের সৃজনশীলতা, আত্মবিশ্বাস আর যোগাযোগদক্ষতা গড়ে তুলতে একটি শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।