শিক্ষা

আগামীকাল থেকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতিতে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকেরা

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা তাঁদের তিন দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আগামীকাল সোমবার (২৬ মে) থেকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন। আজ রোববার ছিল অর্ধদিবস কর্মবিরতির শেষ দিন। শিক্ষক সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

এই কর্মসূচি আহ্বান করেছে প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক ঐক্য পরিষদ, যার নেতৃত্বে রয়েছেন বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন। তিনি গণমাধ্যমে পাঠানো এক লিখিত বিবৃতিতে বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে ন্যায্য দাবিগুলো পেশ করে আসছি। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় বাধ্য হয়েই আমরা পূর্ণদিবস কর্মবিরতির পথ বেছে নিয়েছি।”

তিন দফা প্রধান দাবি কী কী?

প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক ঐক্য পরিষদ দীর্ঘদিন ধরে যে তিনটি দাবি জানিয়ে আসছে, তা হলো—

  1. চাকরির শুরুতেই ১১তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ:
    ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদের নেতৃত্বে গঠিত পরামর্শক কমিটির সুপারিশে প্রস্তাবিত ১২তম গ্রেড নয়, সহকারী শিক্ষকরা শুরুতেই ১১তম গ্রেডে বেতন চান।
  2. ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির জটিলতা নিরসন:
    চাকরির নির্দিষ্ট সময় পর গ্রেড আপগ্রেড পাওয়ার বিষয়টিতে নানা প্রশাসনিক জটিলতা রয়েছে। শিক্ষকরা চান, তা দ্রুত এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হোক।
  3. প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ পদোন্নতির নিশ্চয়তা ও দ্রুত বাস্তবায়ন:
    বর্তমানে প্রধান শিক্ষক পদে সরাসরি নিয়োগ ও পদোন্নতি উভয় ব্যবস্থা থাকলেও, সহকারী শিক্ষকরা চান—শতভাগ পদোন্নতির ভিত্তিতে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হোক।

আন্দোলনের পর্যায়ক্রমিক ধাপ

এই আন্দোলন নতুন নয়। ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি চালিয়ে আসছেন শিক্ষকরা। আন্দোলনের বিবরণ নিচে তুলে ধরা হলো:

  • ৫ মে – ১৫ মে: প্রতিদিন এক ঘণ্টার কর্মবিরতি
  • ১৬ মে – ২০ মে: প্রতিদিন দুই ঘণ্টার কর্মবিরতি
  • ২১ মে – ২৫ মে: প্রতিদিন অর্ধদিবস কর্মবিরতি
  • ২৬ মে থেকে: পূর্ণদিবস কর্মবিরতি (দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত চলবে)

এ আন্দোলনের ফলে দেশের লক্ষাধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাকার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সরকারি উদ্যোগ ও বিতর্ক

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই শিক্ষকদের বেতন কাঠামো পুনর্বিন্যাসের একটি উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী—

  • সহকারী শিক্ষকদের শুরুর বেতন ১২তম গ্রেড
  • প্রধান শিক্ষকদের বেতন ১০ম গ্রেড

এই পরিকল্পনার ভিত্তি হলো আদালতের রায় ও পরামর্শক কমিটির সুপারিশ। কিন্তু সহকারী শিক্ষকরা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁদের বক্তব্য—তাঁরা প্রাথমিক স্তরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাই তাঁদের ন্যূনতম বেতন ১১তম গ্রেডে নির্ধারণ করা উচিত।

শিক্ষক নেতাদের বক্তব্য

আন্দোলনরত শিক্ষক নেতারা বলছেন, দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকদের উৎসাহিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ বর্তমান বেতন কাঠামো তাদের হতাশায় ফেলছে।

এক শিক্ষক বলেন,

“আমরা আমাদের জীবনের মূল্যবান সময় দেশের ভবিষ্যৎ গড়তে ব্যয় করি। অথচ আমাদের সঙ্গে এখনো বৈষম্য করা হচ্ছে। এ বৈষম্য আমরা আর মেনে নেব না।”

অপর এক শিক্ষক বলেন,

“সরকার যদি আমাদের দাবি না মানে, প্রয়োজনে আমরা জাতীয় প্রেসক্লাব বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করব।”

শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কী?

এই আন্দোলনের প্রভাব সরাসরি পড়বে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ওপর। আগামী মাসেই বার্ষিক মূল্যায়ন শুরু হওয়ার কথা। এমন সময়ে শিক্ষকরা কর্মবিরতিতে যাওয়ায় ছাত্রছাত্রীরা শ্রেণিকক্ষে সঠিকভাবে পাঠ পাচ্ছে না। ফলে অভিভাবকরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

ঢাকার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক অভিভাবক বলেন,

“আমরা বুঝি শিক্ষকদের দাবি যৌক্তিক, কিন্তু বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। সরকার দ্রুত সমাধানে না গেলে ক্ষতি আমাদের সন্তানের।”

সম্ভাব্য সমাধান কোন পথে?

শিক্ষাবিদ ও নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, সরকার ও শিক্ষকদের মধ্যে দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে মধ্যমপন্থা বের করা উচিত। কারণ এ আন্দোলনের দীর্ঘস্থায়িত্ব দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও শিক্ষা গবেষক ড. মনজুর কাদির বলেন,

“প্রাথমিক শিক্ষা হল ভিত্তি। সেই ভিত্তিকে দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না। সরকার যদি শিক্ষকদের সম্মান না করে, তাহলে ভবিষ্যতে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা কঠিন হবে।”

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা যেভাবে একাত্ম হয়ে আন্দোলন করছেন, তা থেকে বোঝা যায়, এ দাবি তাঁরা দীর্ঘদিনের এবং ন্যায্য মনে করেন। সরকারের উচিত হবে দ্রুত ও কার্যকর আলোচনার মাধ্যমে একটি সম্মানজনক সমাধানে পৌঁছানো। অন্যথায় দেশের লাখো শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button