সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়েরের পর তাকে আদালতে তোলা হচ্ছে। তার গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে দেশের আইন অঙ্গন, রাজনীতি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে শুরু হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। সুপ্রিম কোর্টের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তার বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তুলেছেন।
কী অভিযোগে গ্রেপ্তার খায়রুল হক?
সকালে রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে গ্রেপ্তার হন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি বিশেষ দল তাকে তার বাসা থেকে আটক করে। খায়রুল হকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে—সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় জালিয়াতি, দুর্নীতি এবং আদালতের রায় পরিবর্তনের অভিযোগ।
শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন। একইসঙ্গে ফতুল্লা থানায় আরও একটি মামলা হয় সংবিধান সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত জালিয়াতি নিয়ে। এসব মামলায় তাকে প্রধান অভিযুক্ত করা হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক বাতিল: যে রায় ঘিরে বিতর্ক
২০১১ সালে আপিল বিভাগের নেতৃত্বে থাকা খায়রুল হক নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। বিশ্লেষকদের মতে, এই রায়ের মাধ্যমেই দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ও গণতন্ত্র চরমভাবে প্রভাবিত হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা অভিযোগ করছেন, এই রায় ছিল একতরফা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশে ভিন্ন ভাষা ব্যবহারের পর পূর্ণাঙ্গ রায়ে এর বিপরীত সিদ্ধান্ত এসেছে বলে তারা দাবি করেছেন। এতে করে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়েছে বলে মত দিয়েছেন অনেক সিনিয়র আইনজীবী।
আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া: “খায়রুল হকের বিচার হতে হবে”
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রায় শুধু গণতন্ত্রকেই নয়, পুরো রাষ্ট্রীয় কাঠামোকেই ধ্বংস করেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ।” তিনি আরও বলেন, “এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কোনো বিচারপতি আর রাজনৈতিক পক্ষপাত নিয়ে রায় দিতে না পারেন।”
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, “এই বিচারপতির কারণে লাখ লাখ মানুষ অন্যায়ভাবে মামলায় জড়িয়েছে। যিনি এক কাপড়ে খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন, তারও বিচার হওয়া উচিত।”
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া: বিএনপির ‘স্বাগত’, শাস্তির দাবি
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাবেক প্রধান বিচারপতির গ্রেপ্তারকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “যদিও অনেক দেরিতে, তারপরও অন্তর্বর্তী সরকারের এই পদক্ষেপকে আমরা সাধুবাদ জানাই।”
তিনি আরও বলেন, “এমন একজন ব্যক্তি যিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।” খায়রুল হকের রায়ের কারণে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, তার দায় থেকে তিনি মুক্তি পেতে পারেন না বলেও মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব।
সাবেক বিচারপতির ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক
সাবেক প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে রাজনৈতিক পক্ষপাত, রায় জালিয়াতি এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নে বারবার বিতর্কে জড়িয়েছেন খায়রুল হক। তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে—বিচার বিভাগীয় রায়ের পূর্ণাঙ্গ অংশে সংক্ষিপ্ত রায় থেকে ভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রদান।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, “একজন বিচারপতি তার শপথ ভেঙেছেন—রাগ, অনুরাগ বা বিরাগ থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা মার্জনাযোগ্য নয়। বিচার বিভাগে আর কখনো এমন প্রতারণা দেখতে চাই না।”
বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকদের মতামত
আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ঘটনা দেশের বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় পরীক্ষা। তাদের মতে, এই বিচার যেন নিরপেক্ষভাবে হয় এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
একজন সিনিয়র আইনজীবী বলেন, “এই বিচার যদি সত্যিকারের স্বচ্ছতার সঙ্গে হয়, তাহলে সেটা হবে ভবিষ্যতের বিচারপতিদের জন্য শিক্ষা।”
বিচার হলে কী বার্তা যাবে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি খায়রুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয় এবং আইনের আওতায় তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়, তবে এটি হবে দেশের বিচারব্যবস্থার এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। এতে করে ভবিষ্যতে কোনো বিচারপতি যদি রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের মাধ্যমে জনগণের বিশ্বাস নষ্ট করতে চান, তবে তার আগে এই নজির কাজ করবে।
সারসংক্ষেপ
খায়রুল হককে আদালতে হাজির করা এবং তার বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়া বাংলাদেশের আইনি ও রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হতে যাচ্ছে। অনেকের মতে, এই বিচার ভবিষ্যতের জন্য একটি বার্তা—বিচারক বলে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। তবে এখন প্রশ্ন রয়ে যায়, এই বিচার কি সত্যিই নিরপেক্ষ ও দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হবে? না কি আবারো আইনি ও রাজনৈতিক বিতর্কে হারিয়ে যাবে ন্যায়বিচার?
এম আর এম – ০৫০০ , Signalbd.com



