ট্রাম্পের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হার্ভার্ডকে সব ধরনের সরকারি অর্থায়ন বন্ধ

যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বন্দ্ব আরও গভীর রূপ নিয়েছে। সর্বশেষ সিদ্ধান্তে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সব ধরনের ফেডারেল বা সরকারি তহবিল দেওয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছেন।
সোমবার (৫ মে) হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি চিঠি পাঠিয়ে এ সিদ্ধান্তের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়টি ভবিষ্যতে আর কোনো গবেষণা অনুদানের জন্য আবেদন করলেও, তা আর অনুমোদন করা হবে না।
মার্কিন প্রশাসনের অভিযোগ: হার্ভার্ড ‘উচ্চশিক্ষাকে অবজ্ঞা করছে’
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার বরাতে জানা গেছে, মার্কিন শিক্ষামন্ত্রী লিন্ডা ম্যাকমাহন এই চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে একাধিক গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। তিনি বলেন, “হার্ভার্ডের আচরণে প্রতীয়মান হয় তারা উচ্চশিক্ষার আদর্শকে অবজ্ঞা করছে। ফলে এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজস্ব তহবিল এবং তাদের সম্পদশালী প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সহায়তা নিয়েই চলতে হবে।”
শুধু তাই নয়, চিঠিতে আরও বলা হয়, “আর কোনো ফেডারেল অনুদানের জন্য আবেদন করে লাভ হবে না। কারণ হার্ভার্ড আর সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান থাকবে না। এটি এখন থেকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো চলবে।”
আরও গুরুতর অভিযোগ: বিদেশি শিক্ষার্থী, সহিংসতা, দুর্বল মানদণ্ড
চিঠিতে শিক্ষামন্ত্রী হার্ভার্ডের বিরুদ্ধে আরও কিছু অভিযোগ করেন। এর মধ্যে রয়েছে দুর্বল একাডেমিক মানদণ্ড, সহিংস আচরণে জড়িত শিক্ষার্থীদের প্রশ্রয় দেওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রকে অবজ্ঞা করে এমন বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো।
তিনি লেখেন, “এই তথাকথিত শিক্ষার্থীরা কোথা থেকে আসে, তারা কারা, কীভাবে তারা আমাদের দেশে এবং হার্ভার্ডে প্রবেশ করে, আর কেন তাদের মধ্যে এত ঘৃণা কাজ করে—এই প্রশ্নের দায়ও হার্ভার্ড এড়াতে পারে না। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—হার্ভার্ড কেন এসব প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিচ্ছে না?”
হার্ভার্ডের তীব্র প্রতিক্রিয়া: ‘আইনবিরুদ্ধ পদক্ষেপ, উচ্চশিক্ষার ওপর আঘাত’
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে অবৈধ এবং প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, “২১ এপ্রিল যে মামলা আমরা দায়ের করেছিলাম, সেটারই প্রতিশোধ নিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।”
তিনি আরও বলেন, “হার্ভার্ড অবশ্যই আইন মান্য করে চলবে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান বজায় রাখবে এবং ইহুদি-বিরোধিতার বিরুদ্ধে লড়াই করবে। পাশাপাশি, এই প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে গবেষণা ও উদ্ভাবনের স্বাধীনতা রক্ষা করার সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।”
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ পদক্ষেপকে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানবিরোধী বলেও অভিহিত করেছে।
পটভূমি: গাজা যুদ্ধ ও ক্যাম্পাস উত্তেজনা থেকেই দ্বন্দ্বের সূচনা
গত মাসে গাজা যুদ্ধ নিয়ে হার্ভার্ড ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক মহলে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ইসরায়েল ও ইহুদি সম্প্রদায়ের নীতির বিরোধিতা করে বিক্ষোভে অংশ নেয় বহু শিক্ষার্থী।
এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প প্রশাসন হার্ভার্ডকে একটি ‘শর্তপত্র’ পাঠায়, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক নীতি, ভর্তি ব্যবস্থা ও মতবিরোধ সহ্য করার সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের দাবি জানানো হয়।
ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি: বিদেশি ঘৃণা, মতবিরোধে শাস্তি, ডিইআই বন্ধ
উক্ত দাবিপত্রে বেশ কিছু বিতর্কিত প্রস্তাব ছিল:
- মার্কিন মূল্যবোধের বিরোধী মনোভাবসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের ফেডারেল কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট করতে হবে।
- মতবৈচিত্র্য নিশ্চিতে প্রত্যেক বিভাগে বাধ্যতামূলক নীতি আনতে হবে।
- ইহুদিবিরোধী হয়রানির অভিযোগে বিভাগীয় তদন্তে সরকারি অনুমোদিত তৃতীয় পক্ষ নিয়োগ করতে হবে।
- পাশাপাশি, ডাইভার্সিটি, ইকুইটি ও ইনক্লুশনের (ডিইআই) নীতিমালা ও কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে।
হার্ভার্ডের প্রত্যাখ্যান ও মামলা
এই দাবিগুলো প্রত্যাখ্যান করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে ফেডারেল আদালতে মামলা দায়ের করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগ, গবেষণার জন্য নির্ধারিত কয়েক বিলিয়ন ডলারের তহবিল হঠাৎ করে স্থগিত করায় হাজারো প্রকল্প ঝুঁকির মুখে পড়েছে এবং এটি প্রশাসনের চরম স্বেচ্ছাচারী পদক্ষেপ।
ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া: প্রতিরোধে আরও কঠোর সিদ্ধান্ত
হার্ভার্ড প্রশাসনের অবস্থান দেখে ট্রাম্প প্রশাসন এর প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত প্রথম দফার ২০০ কোটি ডলারের তহবিল স্থগিত করে। এরপর সোমবার দেওয়া চিঠিতে সরাসরি জানিয়ে দেওয়া হয়, হার্ভার্ড এখন থেকে আর কোনো সরকারি অর্থ পাবে না।
এই সিদ্ধান্তকে মার্কিন উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার জন্য এক ভয়ানক দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখছেন অনেক শিক্ষাবিদ। শিক্ষানীতির বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গবেষণার ওপর এ ধরনের রাজনৈতিক চাপ শুধু শিক্ষা নয়, জাতীয় নিরাপত্তা ও উদ্ভাবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।