বেতন বৈষম্য নিরসনসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলনরত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের কর্মবিরতি ও পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে দ্রুত কাজে যোগদানের নির্দেশ দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছে, নির্দেশ অমান্য করে কাজ না করলে এবং শৃঙ্খলা-বিরোধী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সরকারি চাকরি আইন, আচরণবিধি এবং ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বুধবার (০৩ ডিসেম্বর) বিকেলে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ শিবলী সাদিক স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। শিক্ষকদের চলমান ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির মুখে মন্ত্রণালয়ের এই চূড়ান্ত সতর্কতা দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় এক জটিল অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছে।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ ও কঠোর হুঁশিয়ারি
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের বিজ্ঞপ্তিতে দেশের সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকবৃন্দকে অবিলম্বে কাজে যোগদান করে শিক্ষার্থীদের তৃতীয় প্রান্তিকের পরীক্ষা গ্রহণ সংক্রান্ত বিদ্যালয়ের যাবতীয় কার্যক্রম যথাযথভাবে সম্পন্নের জন্য নির্দেশনা দিয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে:
“এ পরিস্থিতিতে দেশের সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকগণকে অবিলম্বে কাজে যোগদান করে শিক্ষার্থীদের তৃতীয় প্রান্তিকের পরীক্ষা গ্রহণ সংক্রান্ত বিদ্যালয়ের যাবতীয় কার্যক্রম যথাযথভাবে সম্পন্নের জন্য নির্দেশনা দেওয়া যাচ্ছে। অন্যথায় এ ধরনের শৃঙ্খলা-বিরোধী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে চাকুরি আইন, আচরণ বিধিমালা ও ফৌজদারি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
এই চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি প্রমাণ করে যে, সরকার শিক্ষকদের এই আন্দোলনকে আর বরদাস্ত করতে প্রস্তুত নয় এবং পরীক্ষা নিয়ে কোনো আপস করবে না।
শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ
মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষকদের দাবি পূরণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া পদক্ষেপগুলো বিস্তারিত তুলে ধরেছে। সহকারী শিক্ষকদের মূল ৩ দফা দাবি হলো: সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১১তম গ্রেডে নির্ধারণ, ১০ ও ১৬ বছর চাকরি শেষে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির জটিলতা নিরসন এবং প্রধান শিক্ষক পদে সহকারী শিক্ষকদের মধ্য হতে শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি।
মন্ত্রণালয় জানিয়েছে:
১. বেতন গ্রেড নিয়ে আলোচনা: সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডে বেতন প্রদানের দাবিসহ অন্য দুটি দাবি ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ২. উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক: এই দাবি বাস্তবায়নের বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টা এবং বেতন-কমিশনের সভাপতির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করেছেন। ৩. আনুষ্ঠানিক অনুরোধ: এর আগে গত ৭ আগস্ট সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১৩তম গ্রেড হতে ১১তম গ্রেডে উন্নীতকরণের বিষয়টি বিবেচনার জন্য জাতীয় বেতন কমিশনের সভাপতির কাছে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ৪. অর্থ বিভাগের আশ্বাস: সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল উন্নীতকরণের বিষয়টি পে-কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পরপরই অর্থ বিভাগ থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে মর্মে ১০ নভেম্বর অর্থ বিভাগের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে।
চলমান আন্দোলন ও কমপ্লিট শাটডাউন
প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের ব্যানারে গত ২৭ নভেম্বর থেকে সহকারী শিক্ষকদের একাংশ তাঁদের তিন দফা দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করেন। এরপর গত সোমবার (১ ডিসেম্বর) তাঁরা বার্ষিক পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচিও শুরু করেন। বুধবার (৩ ডিসেম্বর) থেকে শিক্ষক সংগঠনগুলো তথাকথিত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি শুরু করেছেন। এর ফলে, তৃতীয় দিনের মতো দেশের অনেক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি।
দেশে বর্তমানে ৬৫ হাজার ৫৬৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে ৩ লাখ ৮৪ হাজারের বেশি শিক্ষক কর্মরত। সহকারী শিক্ষকের অনুমোদিত পদ ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২১৬টি, বর্তমানে কর্মরত ৩ লাখ ৫২ হাজার ২০৮ জন। তাঁদের একাংশের এই কর্মসূচি প্রায় এক কোটিরও বেশি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।
শৃঙ্খলাভঙ্গ ও ফৌজদারি অপরাধের হুঁশিয়ারি
মন্ত্রণালয় অভিযোগ করেছে, সরকারের পক্ষ থেকে দাবি নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়ার পরেও কিছু শিক্ষক সংগঠন চলমান বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণে বাধা বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘কোথাও কোথাও পরীক্ষা নিতে গেলে শিক্ষকদের ওপর হামলা ও শারীরিক লাঞ্ছনার ঘটনাও ঘটেছে।’
মন্ত্রণালয় স্পষ্টভাবে সতর্ক করে দিয়েছে:
‘কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়ে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মসূচি গ্রহণ সরকারি চাকরি আইন, আচরণ বিধিমালার পরিপন্থী এবং ফৌজদারি আইনেও বিবেচ্য।’
এই হুঁশিয়ারি প্রমাণ করে, যারা পরীক্ষা গ্রহণে ইচ্ছুক শিক্ষকদের বাধা দিচ্ছে বা হামলা করছে, তাদের বিরুদ্ধে শুধু প্রশাসনিক নয়, ফৌজদারি আইনেও ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
পূর্ববর্তী সংঘাত ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জের
শিক্ষকদের এই আন্দোলন নতুন নয়। এর আগে গত ৮ থেকে ১২ নভেম্বর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালনকালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে দেড় শতাধিক শিক্ষক আহত হয়েছিলেন। সে সময় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসে শিক্ষকরা কর্মস্থলে ফিরে গেলেও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে অগ্রগতি না হওয়ায় তারা আবার কঠোর আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছেন।
যদিও সরকার দাবি করছে যে, তারা প্রক্রিয়া শুরু করেছে, কিন্তু শিক্ষকদের কাছে সেই অগ্রগতি ‘দৃশ্যমান’ না হওয়ায় তাঁরা আস্থা হারিয়েছেন। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার শিক্ষকদের এই দাবিকে ‘অযৌক্তিক’ এবং আন্দোলনের সময়কে ‘অনৈতিক’ বলে অভিহিত করলেও, মন্ত্রণালয়ের এই বিজ্ঞপ্তি শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানকে আরও নিশ্চিত করেছে।
শিক্ষার ভবিষ্যৎ ও কঠোর ব্যবস্থা
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দেওয়া এই চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি দেশের প্রাথমিক শিক্ষার পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য একটি কঠোর পদক্ষেপ। শিক্ষক সংগঠনগুলোকে অবিলম্বে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে কাজে যোগদান না করলে তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারি চাকরি আইন, আচরণবিধি ও ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। একদিকে শিক্ষকদের ন্যায্য দাবির আংশিক প্রক্রিয়া শুরু, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা—এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য আনা সরকারের জন্য জরুরি। তবে যেকোনো পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরীক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
এম আর এম – ২৪৮৩, Signalbd.com



