নভেম্বর মাসে পুলিশ ও কলেজ কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে মৌখিক ‘শান্তি চুক্তি’ হওয়ার মাত্র তিন সপ্তাহের মাথায় আবারও সংঘর্ষে জড়িয়েছেন ঢাকা কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার (০২ ডিসেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর সাইন্সল্যাব এলাকায় এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বাসের মধ্যে সামান্য কথা-কাটাকাটি থেকে শুরু হওয়া এই সংঘাত এক পর্যায়ে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় রূপ নেয়। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং উভয় কলেজের শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেয়। সংঘর্ষ এড়াতে উভয় পক্ষ গত ৯ নভেম্বর ফুল ও মিষ্টি বিনিময় করে আর সংঘাত না করার প্রতিজ্ঞা করলেও, এই ঘটনা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদ্যমান অবিশ্বাস ও চাপা উত্তেজনাকেই তুলে ধরল।
সংঘর্ষের সূত্রপাত: বাসের মধ্যে কথা কাটাকাটি
মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সাইন্সল্যাব এলাকায় এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। পুলিশ পরিদর্শক ও তদন্ত কমিটি সদস্য ওসি মোহাম্মদ হাফিজ জানান, ঢাকা কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী একই বাসে করে তাদের গন্তব্যের দিকে যাচ্ছিল। বাসের ভিতরেই তাদের মধ্যে সামান্য একটি বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হয়।
কথা কাটাকাটি একপর্যায়ে হাতাহাতিতে রূপ নেয়। এরপর আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিতে শুরু করলে ঢাকা কলেজ সংলগ্ন উত্তরা ব্যাংকের সামনে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার আগেই পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সংঘাত থামিয়ে দেয় এবং সবাইকে নিজ নিজ ক্যাম্পাসে ফেরত পাঠায়।
আইডিয়াল কলেজের অভিযোগ: অতর্কিত হামলা ও উসকানি
আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী বাধঁন মাহবুব সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, তাঁদের কলেজের শিক্ষার্থীরা ছুটি শেষে সাইন্সল্যাব এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই তাঁদের ওপর অতর্কিত হামলা চালানো হয়, যা খুবই নেক্কারজনক। তিনি দাবি করেন, এই ধরনের ঘটনা তাঁদের সঙ্গে প্রতিনিয়তই ঘটে থাকে।
বাধঁন মাহবুব আরও গুরুতর অভিযোগ করেন যে, এই সংঘর্ষের পেছনে ‘ডিসিয়ান মিমস’ এবং ‘ডিসিয়ান ফিক্স’ নামক ফেসবুক পেইজ বা গ্রুপের অ্যাডমিনদের উসকানি রয়েছে। তিনি মনে করেন, গত বছর ঢাকা কলেজের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে হওয়া কনসার্টে দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হওয়া মারামারির জের ধরেই আজকের এই ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে। এই উসকানি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকাও তদন্ত করে দেখা উচিত বলে দাবি করেন তিনি।
ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষের প্রতিক্রিয়া ও কঠোর শাসনব্যবস্থা
ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ এ.কে.এম. ইলিয়াস সংঘর্ষের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘এই বিষয় নিয়ে আমরা সবাই তৎপর আছি। মারামারির সাথে যারা সম্পৃক্ত আছে বিশেষ করে যে মার খেয়েছে, তার প্রতি আমাদের সমবেদনা এবং তাঁর সম্পূর্ণ চিকিৎসার খরচ আমরা বহন করব।’
অধ্যক্ষ ইলিয়াস বলেন, আজকের এই ঘটনা হয়তো বা কনসার্টে ঘটে যাওয়া ঘটনাকেই কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছে। তবে তিনি হুঁশিয়ারি দেন, সব পক্ষই যদি সংযত থাকে, তাহলে এধরনের সংঘাত এড়ানো সম্ভব। ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের শিক্ষার্থীদের কঠোর শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে বলেও জানান তিনি। অধ্যক্ষ বলেন, শান্তি চুক্তির নিয়ম শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী শিক্ষার্থীদের প্রথমে সংযত হওয়ার জন্য সময় দেওয়া হয়, তা না হলে গার্জিয়ানকে ডাকা হয়, এবং এরপরও পরিবর্তন না হলে বহিষ্কার করা হয়, যেমনটি গত কয়েকদিন আগে করা হয়েছে।
মৌখিক ‘শান্তি চুক্তি’ ভঙ্গ
দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘাত এড়াতে গত নভেম্বরের ৯ তারিখে পুলিশ ও কলেজ দু’টির কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে একটি মৌখিক ‘শান্তি চুক্তি’ হয়েছিল। সেই সময় উভয় কলেজের শিক্ষার্থীরা ফুল ও মিষ্টি দিয়ে একে অপরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে নেয় এবং আর কখনো কোনো প্রকার সংঘর্ষে জড়াবে না বলে প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করে।
কিন্তু মাত্র তিন সপ্তাহের মাথায় এই চুক্তি ভঙ্গ হওয়ায় স্থানীয় প্রশাসন ও কলেজ কর্তৃপক্ষ উভয়ই হতাশা প্রকাশ করেছেন। এই চুক্তি ভঙ্গ প্রমাণ করে যে, কেবল মৌখিক প্রতিশ্রুতিতে নয়, বরং শিক্ষার্থীদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী সুসম্পর্ক স্থাপন এবং ভুল বোঝাবুঝি দূর করার জন্য আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
পুলিশের অবস্থান ও সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা
ওসি মোহাম্মদ হাফিজ জানান, সংঘাতের খবর পেয়েই পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় এবং পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে সক্ষম হয়। তিনি বলেন, পুলিশ উভয় কলেজের শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ক্যাম্পাসে পাঠিয়ে দিয়েছে।
বর্তমানে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে গঠিত নয় সদস্যের কমিটির সহায়তায় বিষয়টি মীমাংসা করার জন্য চেষ্টা চলছে। পুলিশের এই উদ্যোগ সংঘাতের পুনরাবৃত্তি রোধে একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। তবে পুলিশ এবং কলেজ কর্তৃপক্ষের পক্ষে এই ধরনের অপ্রত্যাশিত সংঘাতগুলো নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
সংঘাতের সংস্কৃতি ও শিক্ষার পরিবেশ
শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পরও ঢাকা কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যেকার এই সংঘর্ষ প্রমাণ করে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিদ্যমান সংঘাতের সংস্কৃতি এখনও শিকড় গেড়ে আছে। এই ধরনের সংঘাত শুধু শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত জীবনকেই নয়, বরং রাজধানীর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকার শিক্ষার পরিবেশ এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকেও ব্যাহত করে। কলেজ কর্তৃপক্ষের উচিত, শুধুমাত্র শাসন বা বহিষ্কারের হুমকি না দিয়ে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরির জন্য নিয়মিত কাউন্সিলিং এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের আয়োজন করা। সংঘাতের এই পুনরাবৃত্তি রোধে ৯ সদস্যের কমিটিকে অবশ্যই কার্যকর ও স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে।
এম আর এম – ২৪৬৬, Signalbd.com



