শিক্ষা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেই গড়ে উঠেছিল চোলাই মদের কারখানা

Advertisement

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সবুজে ঘেরা নীরব ক্যাম্পাসে গত সোমবার দিবাগত রাতে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা সামনে আসে। জীববিজ্ঞান অনুষদসংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় গড়ে ওঠা গোপন চোলাই মদের কারখানা চবি প্রক্টরিয়াল বডি হঠাৎ করেই চিহ্নিত করে। এ ঘটনায় সুমন চাকমা (৫০) নামের এক ব্যক্তিকে আটক করে পরে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী শিকারের অভিযোগও ওঠেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে নিয়মিত টহল ও নজরদারি চালানো হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ওই পাহাড়ি এলাকাতে বহিরাগতদের অস্বাভাবিক চলাচল প্রক্টরিয়াল বডির নজরে আসে। এরপর গোপন তথ্য ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সোমবার গভীর রাতে অভিযান পরিচালনা করা হয়।

গভীর রাতের অভিযান: তিন ঘণ্টা ধরে তল্লাশি

প্রক্টর অধ্যাপক হোসেন শহীদ সরওয়ার্দীর নেতৃত্বে রাত ১২টা ৩০ মিনিটে অভিযান শুরু হয়। টানা তিন ঘণ্টা তল্লাশির পর রাত ৩টা ৩০ মিনিটে অভিযান শেষ হয়। অভিযান পরিচালনা করেন চবি প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা, যাদের সঙ্গে ছিলেন নিরাপত্তাকর্মীরাও।

অভিযান শেষে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সুমন চাকমা তাঁর ইজারা নেওয়া জমির ছায়ায় এবং ঘরের পাশে দীর্ঘ বারান্দাজুড়ে মদ তৈরির সরঞ্জাম সাজিয়ে রেখেছিলেন। বাঁশ ও টিনের ছোট একটি কুঁড়েঘরের পেছনে তিনি নিয়মিত মদ উৎপাদন করতেন।

৩০ লিটার চোলাই মদসহ সরঞ্জাম উদ্ধার

তল্লাশি শেষে প্রক্টরিয়াল বডি নিশ্চিত করে যে, ওই স্থান থেকে সম্প্রতি প্রস্তুত করা প্রায় ৩০ লিটার চোলাই মদ উদ্ধার করা হয়েছে।
এ ছাড়া পাওয়া গেছে–

  • বড় আকারের ড্রাম
  • প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের পাত্র
  • পাতন (ডিস্টিলেশন) যন্ত্র
  • গাঁজন প্রক্রিয়ার জন্য ব্যবহৃত কন্টেইনার
  • চোলাই মদ তৈরির নানান রাসায়নিক উপকরণ

প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা বলেন, চোলাই মদ উৎপাদনের যন্ত্রপাতি বেশ কিছুদিন ধরেই সক্রিয় ছিল। এর মাধ্যমে নিয়মিত মদ প্রস্তুত হওয়ায় সন্দেহ করা হচ্ছে, ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক একটি সরবরাহ চক্রও থাকতে পারে।

ইজারার আড়ালে অবৈধ ব্যবসা

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, সুমন চাকমা মূলত খাগড়াছড়ির বাসিন্দা। চবি প্রশাসনের কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়ে সেখানে চাষাবাদ করার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু সেই বৈধ কাজের আড়ালেই তিনি গড়ে তোলেন অবৈধ মদ তৈরির কারখানা। একই সঙ্গে পাহাড়ের বন্যপ্রাণী শিকার করে আসছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সহকারী প্রক্টর নুরুল হামিদ জানান—

“তিনি নিয়মিত অবৈধভাবে চোলাই মদ উৎপাদন ও বিক্রি করতেন। বনের ভেতরে বন্যপ্রাণী শিকারেরও প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাঁর ইজারা বাতিল করা হবে এবং নিয়ম অনুযায়ী জরিমানাও করা হবে।”

বন্যপ্রাণী শিকার—নতুন উদ্বেগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বিভিন্ন বিরল প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত।
বিশেষত—

  • মায়া হরিণ
  • শিয়াল
  • বন্য খরগোশ
  • বিভিন্ন প্রজাতির পাখি
  • সরীসৃপ

প্রতিবছর শীতকালে পরিযায়ী পাখিরাও এখানে আশ্রয় নেয়। এ কারণে প্রাণীবৈচিত্র্য রক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পরিবেশবাদী শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন।

এই প্রেক্ষাপটে বন্যপ্রাণী শিকার সংক্রান্ত অভিযোগ শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।

হাটহাজারী থানায় মামলা, আজ আদালতে নেওয়া হবে

অভিযানের পরপরই রাতেই সুমনকে হাটহাজারী থানায় সোপর্দ করা হয়। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনজুর কাদের ভূঁইয়া বলেন—

“পুলিশ বাদী হয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তাঁকে হেফাজতে রাখা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার আদালতে নেওয়া হবে।”

বিশ্ববিদ্যালয়ে অবৈধ মদ উৎপাদন: বৃহত্তর প্রেক্ষাপট

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের চারপাশজুড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চল। অনেক এলাকা জনবসতি ও প্রধান সড়কের দূরে—যা অপরাধীরা কখনো কখনো ব্যবহার করে অবৈধ কার্যক্রমের জন্য। এর আগে বিভিন্ন সময়ে—

  • গাঁজা চাষ
  • অবৈধ কাঠ পাচার
  • বন্যপ্রাণী শিকার
  • চোলাই মদের ছোট–খাটো উৎপাদন
  • বহিরাগতদের অনিয়ন্ত্রিত আনাগোনা

এসব অভিযোগ উঠেছে।

যদিও প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিরাপত্তা জোরদার করে, তবুও পাহাড়ি এলাকার বিস্তৃতি কারণে কিছু অপরাধ চাপা অবস্থায় থেকে যায়।

ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া: ‘ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা আরও কঠোর হওয়া উচিত’

ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। অনেকেই বলেন, চোলাই মদের কারখানার মতো বড় কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন চলছিল—এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

এক শিক্ষার্থী বলেন—
“ক্যাম্পাসের ভেতরেই মদের কারখানা! এটা আমাদের জন্য ভয়ংকর বার্তা। প্রশাসনকে পাহাড়ি এলাকায় আরও সিসিটিভি ও টহল বাড়াতে হবে।”

বিশেষজ্ঞ মতামত: পাহাড়ি ক্যাম্পাসে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বৃহৎ ও পাহাড়ঘেরা ক্যাম্পাসে দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ—

১. স্থায়ী নজরদারি ব্যবস্থা

– পাহাড়ের দূরবর্তী এলাকায় সিসিটিভি স্থাপন
– ড্রোন নজরদারি
– নিয়মিত নিরাপত্তা টহল

২. ইজারা ব্যবস্থার কড়াকড়ি

যাদের জমি ইজারা দেওয়া হয়, তারা আসলে কী করছেন—সেটি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ জরুরি।

৩. পরিবেশ সুরক্ষার বিশেষ টিম

বন্যপ্রাণী শিকার বা পরিবেশ ক্ষতির বিরুদ্ধে বিশেষ টিম কার্যকর হতে পারে।

মদ তৈরির কারখানা কীভাবে গড়ে ওঠে?—একটি প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকায় চোলাই মদ উৎপাদন নতুন নয়। সহজ সরঞ্জাম দিয়ে এবং কম খরচে এই মদ প্রস্তুত করা যায়। এজন্য অপরাধীরা—

  • চাল–গুড়া বা খামির দিয়ে গাঁজন
  • বড় ড্রামে রাখা
  • পরে আগুনে গরম করে পাতনের মাধ্যমে মদ তৈরি

এই প্রক্রিয়া ব্যবহার করে থাকে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেও একই পদ্ধতি ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

চবি প্রশাসন জানিয়েছে, এই ঘটনার পর পাহাড়ি এলাকায় নজরদারি আরও বাড়ানো হবে। সম্ভাব্য পরিকল্পনা—

  • সব ইজারা জমির ভৌত পরিদর্শন
  • বহিরাগত প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ
  • পাহাড়ি এলাকায় আলোর ব্যবস্থা
  • প্রক্টরিয়াল টহল শক্তিশালী করা
  • বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সচেতনতা কার্যক্রম

একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদেরও অনুরোধ করা হয়েছে যাতে তারা কোনো সন্দেহজনক কার্যকলাপ দেখলে সঙ্গে সঙ্গে প্রক্টরিয়াল বডিকে জানায়।

মাদক ব্যবসা ও ক্যাম্পাস—একটি জাতীয় উদ্বেগ

বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে—

  • ইয়াবা
  • ফেনসিডিল
  • চোলাই মদ
  • গাঁজা

এসবের ছোট–বড় ব্যবসা বা লুকানো আড্ডার সন্ধান পাওয়া গেছে।
এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা দিন দিন বাড়াতে হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ঘটনার পর বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
“শুধু আইন প্রয়োগ নয়, শিক্ষার্থীদের মানসিক সহায়তা, মাদকবিরোধী সচেতনতা এবং ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা–সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।”

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে চোলাই মদ তৈরির কারখানা উন্মোচিত হওয়া শুধু একটি সংবাদই নয়—এটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী, পরিবেশ রক্ষাবিদ এবং শিক্ষার্থীদের জন্য বড় একটি সতর্কবার্তা। পাহাড়ি অঞ্চলের আড়ালে অপরাধীরা কীভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে, এই ঘটনা তার বড় উদাহরণ।

এই ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে সুমন চাকমাকে। তাঁর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছে। ইজারা বাতিল, জরিমানা এবং বন্যপ্রাণী শিকারের অভিযোগও তদন্তে আসতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, ভবিষ্যতে এমন ঘটনা প্রতিরোধে তারা আরও কঠোর হবে।

MAH – 14094 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button