দাবি বাস্তবায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়ায় দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মঙ্গলবারও (০২ ডিসেম্বর) লাগাতার পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করছেন শিক্ষকরা। ফলে টানা দ্বিতীয় দিনের মতো স্থগিত থাকছে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের এই কঠোর কর্মসূচির কারণে দেশের ৬৫ হাজারেরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩ লাখ ৮৪ হাজারের বেশি শিক্ষক কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকছেন। বেতন স্কেলের বৈষম্য দূরীকরণ, উচ্চতর গ্রেড জটিলতার নিরসন এবং শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি—এই তিন দফা দাবিতে শিক্ষকরা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন এবং বছরের শেষ প্রান্তিকের পরীক্ষা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
কর্মবিরতির ধারাবাহিকতা ও পরিষদের ঘোষণা
প্রাথমিক শিক্ষকদের এই লাগাতার কর্মবিরতি কর্মসূচি চলছে প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ-এর ব্যানারে। পরিষদ জানিয়েছে, সোমবার সারাদেশে তৃতীয় দিনের মতো সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরীক্ষা বর্জন ও পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালিত হয়েছে। দাবি আদায়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া বা কার্যকর পদক্ষেপ না আসায় মঙ্গলবারও কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে।
সোমবার (০১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক আবুল কাসেম মোহাম্মদ শামছুদ্দীন এক বিবৃতিতে কর্মসূচির ধারাবাহিকতা ঘোষণা করেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, দাবি পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষকরা তাদের এই পূর্ণদিবস কর্মবিরতি থেকে সরে আসবেন না। এর ফলে, নির্ধারিত সময়ে বার্ষিক পরীক্ষা সম্পন্ন করা এবং ফলাফল প্রকাশ নিয়ে গভীর জটিলতা তৈরি হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) এই পরিস্থিতিতে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
সহকারী শিক্ষকদের মূল ৩ দফা দাবি
প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে যে তিনটি প্রধান দাবি জানানো হচ্ছে, সেগুলো হলো:
১০ম গ্রেডে বেতন স্কেল নির্ধারণ
শিক্ষকদের প্রধান এবং সবচেয়ে জোরালো দাবি হলো সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১৩তম গ্রেড থেকে উন্নীত করে সরাসরি ১০ম গ্রেডে নির্ধারণ করা। বর্তমানে প্রধান শিক্ষকরা দশম গ্রেডে বেতনভুক্ত হলেও, সহকারী শিক্ষকরা এখনও ১৩তম গ্রেডে রয়েছেন। শিক্ষকরা মনে করেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কাজের পরিধি বিবেচনা করে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে বেতন গ্রেডের এই বড় বৈষম্য অন্যায় ও অগ্রহণযোগ্য। তারা প্রাথমিক শিক্ষার মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হলেও তাদের নিম্ন বেতন স্কেল তাদের জীবনযাত্রার মান এবং পেশাগত মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করছে।
উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তিসংক্রান্ত জটিলতার নিরসন
শিক্ষকদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হলো ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তিসংক্রান্ত জটিলতার নিরসন। অনেক সহকারী শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে একই পদে চাকরি করার পরও পদোন্নতি বা উচ্চতর গ্রেড সুবিধা পাচ্ছেন না। উচ্চতর গ্রেড পেতে হলে যে জটিল প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, তাতে অনেক শিক্ষকই নির্দিষ্ট সময়ে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই জটিলতা অবিলম্বে দূর করে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তি সহজ করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি
শিক্ষকদের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ দাবি হলো, সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি নিশ্চিত করা। বর্তমানে প্রধান শিক্ষক পদে সরাসরি নিয়োগ ও বিভাগীয় পদোন্নতি উভয় পদ্ধতিই চালু রয়েছে। শিক্ষকরা চান, প্রাথমিক শিক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে নিয়োজিত ও অভিজ্ঞ সহকারী শিক্ষকদের জন্য প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ পদোন্নতির সুযোগ রাখা হোক। এতে তাঁদের মধ্যে পেশাগত অনুপ্রেরণা বাড়বে এবং প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার ভিত মজবুত হবে।
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও সংঘাতের ইতিহাস
শিক্ষকদের এই আন্দোলন হঠাৎ করে শুরু হয়নি। তাদের দাবি আদায়ের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ ও সংগ্রামপূর্ণ। এর আগে গত ৮ থেকে ১২ নভেম্বর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে প্রাথমিক শিক্ষকরা লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছিলেন। ওই সময় নিজেদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নেওয়া শিক্ষকদের ওপর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, যেখানে দেড় শতাধিক শিক্ষক আহত হন।
পরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়নের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সেই আশ্বাসের ভিত্তিতেই শিক্ষকরা তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে কর্মস্থলে ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন কেটে গেলেও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি না হওয়ায়, শিক্ষকরা সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে আবার কঠোর আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছেন। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের এই ঘটনা শিক্ষকদের মধ্যে গভীর ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম দিয়েছে।
প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া: পরীক্ষা স্থগিত ও ছাত্রছাত্রীদের ভোগান্তি
কর্মবিরতির সবচেয়ে সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা ও লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ওপর। দেশে ৬৫ হাজার ৫৬৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ২ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত হওয়ায় শিক্ষাজীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাদের পড়ালেখা ব্যাহত হচ্ছে।
অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের পরীক্ষা নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন। পরীক্ষার নতুন সময়সূচি কবে ঘোষণা হবে, আদৌ এই শিক্ষাবর্ষে পরীক্ষা শেষ করা সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, পরীক্ষার মতো একটি অপরিহার্য প্রক্রিয়া এভাবে বারবার বাধাগ্রস্ত হলে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয় এবং তারা মানসিক চাপে ভোগে। দেশের প্রাথমিক শিক্ষার এই বৃহৎ অংশকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেওয়ায় দ্রুত একটি সমাধান জরুরি।
মতামত: গ্রেড বৈষম্যের যৌক্তিকতা
শিক্ষাবিদ এবং বেতন-কাঠামো বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেডের দাবি যৌক্তিক এবং বেতন বৈষম্য দূরীকরণে অপরিহার্য। তারা বলেন, বর্তমানে সহকারী শিক্ষকদের যে গ্রেড দেওয়া হয়, তা তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং সরকারি চাকরির অন্যান্য পদের সঙ্গে তুলনা করলে যথেষ্ট নয়।
বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করেন, প্রাথমিক শিক্ষা দেশের ভিত্তিমূল। এই শিক্ষকদের মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। শিক্ষকদের এই আন্দোলনকে কেবল আর্থিক দাবি হিসেবে না দেখে, প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নের একটি অংশ হিসেবে দেখা উচিত। সরকারের উচিত দ্রুততার সঙ্গে শিক্ষকদের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনায় বসে তাদের দাবিগুলো মেনে নিয়ে শিক্ষার পরিবেশ স্বাভাবিক করা।
জরুরি সমাধান না হলে বাড়বে ক্ষতি
প্রাথমিক শিক্ষকদের লাগাতার কর্মবিরতি দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় এক গভীর অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছে। একদিকে শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি, অন্যদিকে লাখো শিক্ষার্থীর বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা। দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা এই সমস্যার দ্রুত ও স্থায়ী সমাধান না হলে প্রাথমিক শিক্ষার ভবিষ্যৎ আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। শিক্ষকদের প্রতি সরকারের অতীতের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জের ধরেই আজকের এই কঠোর আন্দোলন। এই পরিস্থিতিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ এবং সময়সীমা ঘোষণা করে অবিলম্বে তাদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার করিয়ে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিশ্চিত করাই এখন সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এম আর এম – ২৪৪০,Signalbd.com



