বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক বিরাট সাফল্যের সংকেত হিসেবে সামনে এসেছে চলতি জুলাই মাসের প্রথম ১৬ দিনে বৈধ পথে প্রবাসী আয় ৭ দশমিক ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার খবর। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ প্রবাসী রেমিট্যান্স এসেছে, যা দেশের অর্থনীতিকে শক্তি যোগাচ্ছে এবং মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করছে।
প্রবাসী আয় বৃদ্ধি: দেশের অর্থনীতির বড় চালিকাশক্তি
বাংলাদেশে বৈধ পথে প্রবাসী আয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জোগাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ১ থেকে ১৬ জুলাই ২০২৫ তারিখের মধ্যে প্রবাসী আয় হয়েছে ১৪২ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ে প্রাপ্ত ১৩১ কোটি ৯০ লাখ ডলারের তুলনায় ৭ দশমিক ৭০ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছর ২০২৪-২৫ সালে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ৩০ দশমিক ০৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে এক সর্বোচ্চ রেকর্ড। গত অর্থবছরের তুলনায় (২৩ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার) প্রায় ২৬ শতাংশ বেড়েছে প্রবাসী আয়, যা দেশের অর্থনীতির জন্য দারুণ ইতিবাচক ইঙ্গিত।
প্রবাসী আয় বৃদ্ধির কারণ ও প্রভাব
১. বৈধ পথে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি
প্রবাসীরা মূলত ব্যাংক ও বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ পাঠাচ্ছেন। ব্যাংকিং খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের প্রসার প্রবাসীদের জন্য রেমিট্যান্স পাঠানো সহজ ও নিরাপদ করেছে।
২. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সঞ্চয়
বেশি প্রবাসী আয় আসায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী হচ্ছে। এটি আমদানি সহজ করতে সাহায্য করে, মুদ্রার মূল্য স্থিতিশীল রাখে এবং বিদেশি ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বাড়ায়।
৩. মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা
রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়ে গেলে দেশের ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধি পায়, যার ফলে মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম আপেক্ষিক কমে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক গত কয়েকদিনে বাজারে ডলার কেনা-বেচার মাধ্যমে টাকার দাম নিয়ন্ত্রণ করছে।
ডলারের দাম ও মুদ্রাবাজার পরিস্থিতি
বাংলাদেশে ডলারের দাম আপাতত ১২০ থেকে ১২৫ টাকার মধ্যে স্থিতিশীল রয়েছে। ব্যাংকগুলো ১২১ টাকা ২০ পয়সা থেকে ১২১ টাকা ৩০ পয়সার মধ্যে ডলার লেনদেন করছে। জুন মাসে ডলারের দাম ছিল ১২২ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ১২৩ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ ডলারের মূল্য ওঠানামা খুব বেশি হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত সপ্তাহে ১৭ কোটি ১০ লাখ ডলার ও পরবর্তী দিনগুলোতে ৪৮ কোটি ডলার কিনেছে, যা মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক। এর ফলে আমদানিতে ব্যবহৃত মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আমদানিতে বিধিনিষেধ শিথিলের দাবি
মুদ্রাবাজারে ডলার সরবরাহে স্বস্তি ফিরে আসায় অর্থনীতির বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠন ও ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এখন আমদানিতে বিধিনিষেধ শিথিল করার সময় এসেছে। বিশেষ করে বিলাসপণ্য ও অবশিষ্ট আমদানিতে অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করার পরিবর্তে সহজতর নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন।
বিধিনিষেধ শিথিল হলে আমদানি বৃদ্ধি পাবে, যা উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। এতে দেশে শিল্প-কারখানা সচল থাকবে এবং অর্থনীতির গতি বৃদ্ধি পাবে।
প্রবাসী আয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ: ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
প্রবাসী আয় শুধু মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে না, এটি দেশের উন্নয়ন প্রকল্পেও অবদান রাখে। উন্নত অবকাঠামো নির্মাণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক কল্যাণে প্রবাসীদের পাঠানো টাকা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে।
এছাড়া, বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। প্রবাসীদের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হন।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা
বেশি দেশেই এখন অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই তুলনায় বাংলাদেশে প্রবাসী আয় ও মুদ্রাবাজার স্থিতিশীলতা দেশের অর্থনীতিকে তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে রাখছে।
বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় মুদ্রার মূল্য স্থিতিশীল থাকার কারণে আমদানিকারকরা সুবিধা পাচ্ছেন। বাংলাদেশের রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ানোর মাধ্যমে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্ভব হচ্ছে।
প্রবাসীদের অবদান: দেশের অর্থনীতির প্রাণ
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে প্রবাসীদের অবদান অপরিসীম। বিশ্বের নানা প্রান্তে থেকে বাংলাদেশি প্রবাসীরা নিয়মিত টাকা পাঠিয়ে দেশের কোটি কোটি মানুষকে সচ্ছল জীবনযাত্রার সুযোগ করে দিচ্ছেন।
বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের কর্মরত বাংলাদেশিরা বৈধ পথে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছেন, যা প্রবাসী আয় বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ।
দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি কেন গুরুত্বপূর্ণ
- ৭.৭০% বৃদ্ধি: জুলাইয়ের প্রথম ১৬ দিনে প্রবাসী আয় বেড়েছে ৭ দশমিক ৭০ শতাংশ।
- রেকর্ড আয়: ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসী আয় হয়েছে ৩০ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের সর্বোচ্চ।
- মুদ্রাবাজার স্থিতিশীলতা: ডলারের দাম ১২০-১২৫ টাকার মধ্যে স্থিতিশীল রয়েছে।
- বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা: বাজারে ডলার সরবরাহ বাড়াতে বিপুল পরিমাণ ডলার কেনা হয়েছে।
- আমদানিতে শিথিলতা দাবি: আমদানি ও ব্যবসায়িক গতি বৃদ্ধির জন্য বিধিনিষেধ শিথিল করতে হবে।
- অর্থনীতিতে প্রবাসী আয়: দেশের উন্নয়ন, বিনিয়োগ ও সামাজিক কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।



