শিক্ষা

ডিজিটাল ফেতনা প্রতিরোধে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি শিক্ষা অপরিহার্য

Advertisement


অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ. ফ. ম. খালিদ হোসাইন সম্প্রতি কক্সবাজারে এক মাদরাসা‑জলসায় বলেন, ডিজিটাল ফেতনার এই যুগে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জন করা জরুরি। তিনি মাদরাসা শিক্ষাকে কেবল ধর্মীয় জ্ঞান বলেই সীমাবদ্ধ না রাখতে চান — আলোচনায় রয়েছে কোরআন‑হাদিসের সঙ্গে কম্পিউটার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে একত্রিত করে ইসলামী মূল্যবোধ আরও মজবুত করার দৃষ্টিভঙ্গি। মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যাতে আধুনিক ডিজিটাল শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, সেই লক্ষ্যে তিনি পরিকল্পনাসমূহ গঠন করার প্রস্তাব দেন। সে সঙ্গে, নারীদের অংশীদারিত্ব বাড়াতে বলেও তিনি উল্লেখযোগ্য মন্তব্য করেছেন।

বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল প্রযুক্তি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং একই সঙ্গে তথ্যপ্রচারে নানা পক্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলাম ও মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ভুল তথ্য বা অপপ্রচার (“ডিজিটাল ফেতনা”) ছড়ানো হচ্ছে — এমন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ. ফ. ম. খালিদ হোসাইন

তিনি বলেন, এখন আমরা শুধু পারস্পরিক বিশ্বাস বা ধর্মীয় ধর্মশিক্ষার যুদ্ধক্ষেত্রে নেই, বরং একটি ডিজিটাল যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং ডিজিটাল চ্যানেলগুলো ইসলামের বাণী পৌঁছে দিতে যেমন শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে, ঠিক তেমনি এগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার না হলে ফেতনার হাতিয়ারও হয়ে উঠতে পারে। এ কারণেই, মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক শিক্ষা অর্জন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

তিনি বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর, ২০২৫) সকালে কক্সবাজার জামিয়াতুল ইসলাম মুসলিম (রহ.) মাদরাসা‑তে অনুষ্ঠিত “সহীহ বুখারি দরসে হাদিসের আজিমুশশান জরসা” অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে তার বক্তব্যে এসব কথা বলেন।

মূল বক্তব্য ও বিশ্লেষণ

  1. ডিজিটাল ফেতনা ও প্রতিহিংসা:
    • ড. খালিদ হোসাইন বলেন, “আমরা এখন যুদ্ধক্ষেত্রে আছি” — এখানে বোঝানো হচ্ছে যে, বর্তমানে ইসলামী মূলবাণীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ এবং অপপ্রচারের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।
    • তিনি সতর্ক করেন যে, যারা ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা ছড়িয়ে দিচ্ছে তারা ডিজিটাল মাধ্যমকে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করছে। তাই মাদরাসার শিক্ষক এবং ছাত্ররা যাতে ইতিমধ্যেই সেই মাধ্যম শিখে পারে এবং নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি সুষ্ঠু ও শক্তিশালীভাবে তুলে ধরতে পারে, সেটি প্রয়োজন।
  2. মাদরাসার শিক্ষাকে আধুনিকীকরণ:
    • শুধু কোরআন, হাদিস এবং ফেকাহ‑আকিদার শিক্ষা দিয়েই কাজ শেষ করা যাবে না — প্রযুক্তি, কম্পিউটার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও শিক্ষা দিতে হবে।
    • তিনি যুক্তি দেন, মাদরাসার শিক্ষক এবং ছাত্ররা যদি প্রযুক্তি‑সচেতন হয়, তবে তারা “ইসলাম প্রচার ও কর্মযজ্ঞে” ডিজিটাল মাধ্যমকে শক্তিশালী উপায়ে কাজে লাগাতে পারবে।
    • এ প্রসঙ্গে, যদিও ইসলামিক শিক্ষা গুরুত্বপুর্ণ, কিন্তু অতিরিক্ত আধুনিক সাবজেক্টগুলোর সঙ্গে ভারসাম্য রেখে এগোনোর প্রয়োজন আছে।
  3. নারী শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ও ক্ষমতায়ন:
    • ধর্ম উপদেষ্টা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, মাদরাসা শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো উচিত — বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাফেজা ও আলেমা হিসেবে গড়ার দিকে নজর দিতে হবে।
    • তিনি বলেন, “অর্ধেক নারী এই দেশে,” — বোঝাতে চেয়েছেন যে দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ নারী, এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে তাদের শিক্ষাগত উন্নয়ন ও নেতৃত্বগত অংশগ্রহণ বাড়ানো সম্ভব।
    • নারীদের জন্য মাদরাসা শিক্ষা শুধু ধর্মীয় শিক্ষা নয়; এটি একটি সুযোগ হতে পারে তাদের সামাজিক ও পেশাগত ক্ষমতায়নের জন্য।
  4. মাদরাসার ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য:
    • ড. খালিদ বিভিন্ন সময়ই বলছেন যে, মাদরাসা শিক্ষা একটি বিশেষায়িত শিক্ষাব্যবস্থা, এবং এটি তার ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে হবে। I
    • “অতি আধুনিকতার নামে মাদরাসা শিক্ষাকে ধ্বংসের মুখে পতিত হতে দেওয়া যাবে না,” — এমনভাবেই তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যাতে মাদরাসার মূল ধর্মীয় এবং ইসলামি ভিত্তি বিলুপ্ত না হয়।
    • তিনি আরও বলেন, মাদরাসার শিক্ষা শুধুমাত্র ধর্মীয় জ্ঞান নয় — অতীতের মাদরাসাগুলো যুক্তিবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, বিজ্ঞান ও ধর্মবিদ্যার সম্মিলিত চর্চার কেন্দ্র ছিল।
    • ধর্ম উপদেষ্টা ঢাকা আলিয়া মাদরাসার গুরুত্বও তুলে ধরেন, এবং বলেন যে, এটি উপমহাদেশীয় মাদরাসা শিক্ষার ঐতিহ্যে বিশেষ অবদান রেখেছে।
  5. নিরাপত্তা ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ:
    • যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠী “মাদরাসা শিক্ষার টুটি ধরতে চায়” — অর্থাৎ, যারা মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত করতে চায় — তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, এমন বার্তা দিয়েছেন তিনি।
    • তিনি সতর্ক করেছেন যে, ফ্যাসিবাদ পুনরায় সৃষ্টি হতে পারে, তাই সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
    • একই সঙ্গে, তিনি মাদরাসা শিক্ষার্থীদের হতাশাগ্রস্ত না হতে ও আশাবাদী থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন। +1
  6. উচ্চ শিক্ষা ও হাফেজদের গুরুত্ব:
    • ড. খালিদ বলছেন, যারা কোরআন হিফজ (হাফেজ) করছে, শুধু হিফজেই থেমে থাকা উচিত নয়; তাদের উচ্চশিক্ষাও গ্রহণ করতে হবে।
    • তিনি হাফেজাদেরকে নেতৃত্ব দানে উৎসাহিত করেছেন এবং বলছেন, তারা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিজ দক্ষতা প্রয়োগ করতে পারে।
    • এভাবে, ধর্মীয় শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষাকে মিশিয়ে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ নিশ্চিত করার এক পরিকল্পনা তাঁর দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ।

প্রেক্ষাপট ও প্রাসঙ্গিক তথ্য

  • কোন প্রেক্ষাপট থেকে কথাগুলো এসেছে?
    এই মন্তব্যগুলো এসেছে কক্সবাজার জামিয়াতুল ইসলাম মুসলিম মাদরাসার দরস‑জলসায়, যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ধর্ম উপদেষ্টা। এটি কেবল ধর্মীয় বক্তৃতা নয়, বরং একটি কৌশলগত বার্তা — মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিক বিশ্বের সাথে মানানসই করার প্রয়াস।
  • উপদেষ্টার ভূমিকা ও পরিচয়:
    ড. আ. ফ. ম. খালিদ হোসাইন বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা।
    তিনি ইসলামী বিদ্যাকেন্দ্রে সক্রিয়ভাবে যুক্ত এবং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে গভীর আগ্রহী। তাঁর বক্তৃতাগুলো শুধুমাত্র ধর্মীয় বিতর্কেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমাজে ধর্ম‑শিক্ষার ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ নিয়ে পরিকল্পিত দৃষ্টিভঙ্গা তুলে ধরে।
  • মাদরাসা শিক্ষার বর্তমান দৃষ্টান্ত:
    মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় গত সময়গুলোতে আধুনিক শিক্ষা — যেমন বিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা, সফটওয়্যার — অন্তর্ভুক্ত করার প্রবণতা বেড়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমেও আলাপ আছে।
    একই সঙ্গে, মাদরাসার ঐতিহ্য রক্ষা করার কথা উপদেষ্টা বারবার বলছেন, কারণ শুধু আধুনিকতার জন্য যদি ধর্মীয় ভিত্তি ম্লান হয়ে যায়, তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক উদ্দেশ্য বিপদে পড়তে পারে।
  • নারী শিক্ষার প্রসার:
    মাদরাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীর ভূমিকা বৃদ্ধির কথা বলা মানে শুধুমাত্র কোরআন‑হিফজ বা আরবি শিক্ষা নয়, নারীদের পক্ষে উচ্চতর ধর্মীয় নেতৃত্ব, আলেমা বা সমাজে ইসলামী ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গা গড়ার সুযোগ তৈরি করা।
  • ডিজিটাল দক্ষতা ও ইসলামী মূল্যবোধ:
    আজকের বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তি এবং ডিজিটাল মাধ্যম ধর্মীয় সম্প্রচার, দাওয়াহ এবং মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ তৈরি করেছে। কিন্তু সেগুলোর সঠিক ব্যবহার না হলে বিপদও রয়েছে — যেমন ভুল তথ্য, গুজব, উস্কানি বা বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া। ধর্ম উপদেষ্টার বার্তা হলো, মাদরাসা শিক্ষার্থীদের এ ক্ষেত্রে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য নিজেকে সক্ষম করতে হবে।

মূল্যায়ন ও গুরুত্ব

  • ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রয়োজন:
    ড. খালিদ হোসাইনের এই দৃষ্টিভঙ্গা মাদরাসা শিক্ষাকে শুধুমাত্র ঐতিহ্যগত ও ধর্মীয় শিক্ষা হিসেবে না দেখে, এক যুগোপযোগী শিক্ষামডেলে রূপান্তর করার পরিকল্পনার প্রতিফলন। এটি কেবল মাদরাসা ছাত্রদের দক্ষতা বাড়াবে না, বরং ইসলামী সমাজকে ডিজিটাল কৌশলগতভাবে সুসংহত করার পাথেয় হতে পারে।
  • চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা:
    যদিও তার কথাগুলো গুরত্বপূর্ণ, বাস্তবে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রয়োজন হবে উল্লেখযোগ্য বাজেট, প্রশিক্ষণ সম্পদ, সেই সঙ্গে শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গা পরিবর্তন। পাশাপাশি, ডিজিটাল নিরাপত্তা, ডিজিটাল লিটারেসি ও নৈতিকতা বিষয়েও সচেতনতা থাকতে হবে, যাতে “ডিজিটাল ফেতনা” মোকাবিলা করা যায়।
  • সামাজিক প্রভাব:
    মাদরাসার শিক্ষার্থীরা যদি ডিজিটাল দক্ষ হয়ে ওঠে, তারা ইসলামের সত্যিকারের বার্তাকে অনলাইনে আরও দক্ষতার সঙ্গে ছড়িয়ে দিতে পারবে — যেমন সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, ওয়েবিনার, অনলাইন দাওয়াহ প্ল্যাটফর্ম। এতে ইসলামী চিন্তাধারা তরুণ প্রজন্মের কাছে আরও প্রাসঙ্গিক ও আকর্ষণীয় হতে পারে।
  • নারীর ক্ষমতায়ন:
    নারীদের মাদরাসা শিক্ষা ও নেতৃত্বের দিকে এগিয়ে নেওয়ার দৃষ্টিকোণ অত্যন্ত ইতিবাচক। এটি মাদরাসার সমাজগত ও ধর্মীয় গুরুত্বকে আরও বিস্তৃত করবে এবং নারীদের জন্য নতুন পথ খুলবে, যেখানে তারা আলেমা বা হাফেজা হিসেবে নিজ দৃষ্টিভঙ্গা প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

ড. আ. ফ. ম. খালিদ হোসাইনের কথাগুলো একটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে: মাদরাসা শিক্ষা শুধুমাত্র অতীতের স্মৃতি নয়, ভবিষ্যতের পথও হতে পারে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষা একসাথে সম্পৃক্ত করা হলে, মাদরাসার শিক্ষার্থীরা কেবল ধর্মীয় জ্ঞানই অর্জন করবে না — তারা একটি কার্যকরী, জ্ঞানভিত্তিক ইসলামী নেতৃত্ব গড়তে পারবে, যা ডিজিটাল বিশ্বের প্রসঙ্গেও প্রাসঙ্গিক এবং শক্তিশালী হবে।

ডিজিটাল ফেতনার সময়েই, যদি মাদরাসা শিক্ষা কল্যাণময় ও গতিশীলভাবে গড়ে তোলা যায়, তা হলে ইসলামের সত্যিকার বার্তাকে আরও দক্ষতার সঙ্গে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। এ জন্য শিক্ষক, ছাত্র এবং মাদরাসা সম্প্রদায়ের সচেতনতা, পরিকল্পনা ও কঠোর পরিশ্রম অপরিহার্য।

MAH – 13900 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button