শিক্ষা

সারা দেশে মিড-ডে মিল শুরু, ৩১ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য

Advertisement

কয়েক দফা পেছানো এবং নানা প্রশাসনিক জটিলতা সত্ত্বেও অবশেষে দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বহুল প্রতিক্ষীত ‘ফিডিং কর্মসূচি’ বা ‘মিড-ডে মিল’ চালু হয়েছে। শনিবার নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার আনুষ্ঠানিকভাবে এ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন।

এর মধ্য দিয়ে দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো দীর্ঘদিন আলোচিত এই জাতীয় স্কুল ফিডিং কর্মসূচি, যা পর্যায়ক্রমে বিস্তৃত করে পুরো দেশে নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

১৫০টি উপজেলা—১৯,৪১৯টি বিদ্যালয়—৩১,১৩,০০০ শিক্ষার্থী

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, প্রথম পর্যায়ে ১৫০টি উপজেলার ১৯ হাজার ৪১৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩১ লাখ ১৩ হাজার শিক্ষার্থী নিয়মিত ‘মিড-ডে মিল’ পাবে।

২০২৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই কর্মসূচি চলবে এবং প্রয়োজনীয় মূল্যায়ন শেষ হলে তা আরও সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও রয়েছে।

প্রতিদিন সপ্তাহে পাঁচ দিন শিক্ষার্থীরা যে খাবারগুলো পাবে:

  • ফর্টিফায়েড বিস্কুট
  • কলা বা মৌসুমি ফল
  • বনরুটি
  • সেদ্ধ ডিম
  • ইউএইচটি দুধ

এই খাবারের তালিকা শিশুদের বয়স, প্রয়োজনীয় ক্যালোরি, পুষ্টিমান এবং সহজ সরবরাহব্যবস্থা বিবেচনায় তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে শিক্ষা অধিদপ্তর।

শিক্ষার গুণগত মান ও অপুষ্টি দূরীকরণে বড় ভূমিকা রাখবে: সরকার

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গণশিক্ষা উপদেষ্টা ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন—
“বিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এই ফিডিং কর্মসূচি শুধু ক্ষুধা দূর করবে না, বরং প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নেও বড় ভূমিকা রাখবে।”

তিনি আরও বলেন—
“এ উদ্যোগের ফলে শিশুরা স্কুলে আসতে আগ্রহী হবে, ক্লাসে মনোযোগ বাড়বে এবং দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক ও মানসিক বিকাশও ত্বরান্বিত হবে।”

উপস্থিতি বাড়বে ৮০% এর বেশি, ঝরেপড়া কমবে—প্রত্যাশা সরকার ও উন্নয়ন সংস্থার

সরকার, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মূল্যায়নে দেখা গেছে—

  • যেসব দেশে স্কুল মিল বা ফিডিং কর্মসূচি চালু আছে, সেসব দেশে বিদ্যালয় উপস্থিতি ২০–৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়
  • অপুষ্টিজনিত সমস্যা কমে এবং শিক্ষার্থীদের শেখার ক্ষমতা উন্নত হয়।

বাংলাদেশ সরকারও মনে করছে, এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন হলে—

  • বিদ্যালয় উপস্থিতি ৮০ শতাংশের বেশি হবে
  • প্রাথমিক স্তরের ঝরেপড়া উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে
  • প্রকৃত ভর্তির হার প্রতি বছর ১০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পাবে
  • শিশুদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখার হার ৯৯ শতাংশে উন্নীত হবে
  • শিক্ষার্থীদের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের হার ৯০% এর বেশি হবে

দীর্ঘ বিলম্ব, টেন্ডার জটিলতা—অবশেষে সব বাধা পেরিয়ে উদ্বোধন

মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, প্রশাসনিক প্রস্তুতি, বাজেট অনুমোদন এবং বিশেষ করে টেন্ডার জটিলতার কারণে কর্মসূচির উদ্বোধন বেশ কয়েকবার পিছিয়ে যায়।

  • চলতি বছরের জানুয়ারিতে এটি শুরু হওয়ার কথা ছিল
  • পরে জুনে পেছায়
  • এরপর সেপ্টেম্বরেও সময় ঘোষণা করা হয়েছিল
  • সর্বশেষ টেন্ডারের আপত্তি নিষ্পত্তি হওয়ায় নভেম্বর মাসে এসে উদ্বোধন সম্ভব হলো

এ সময়সীমার বিলম্বে শিক্ষাবিদ, অভিভাবক এবং নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে হতাশা তৈরি হলেও অবশেষে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুন আশা দেখা দিয়েছে।

৫,৪৫২ কোটি টাকার বিশাল প্রকল্প—৯৭% ব্যয় খাবারের জন্য

এই জাতীয় ফিডিং প্রকল্পে মোট ৫ হাজার ৪৫২ কোটি টাকার বেশি ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে—

  • ৯৭ শতাংশ ব্যয় শুধুমাত্র খাবার সরবরাহের জন্য
  • অবশিষ্ট ব্যয় ব্যবস্থাপনা, পরিদর্শন, পরিবহন ও প্রকল্প পরিচালনায় ব্যবহার হবে

চলতি অর্থবছর (২০২৫–২৬) এ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকারও বেশি।

বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলোর একটি বলে মন্তব্য করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ কর্মসূচি কেন এত প্রয়োজন?—গবেষণা যা বলছে

বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তরের প্রায় ৩০–৩৫ শতাংশ শিশু কোনো না কোনো পর্যায়ে অপুষ্টিতে ভোগে। গ্রামীণ এলাকায় এই হার আরও বেশি।

গবেষণা দেখায়:

  • খালি পেটে স্কুলে গেলে শিশুদের মনোযোগ কমে
  • শারীরিক শক্তি কম থাকায় ক্লাসে সক্রিয়তা কমে
  • দীর্ঘমেয়াদে শেখার দক্ষতা কমে যায়

এ কারণে বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশে স্কুল মিল কর্মসূচি চলছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা বহু বছর আগে এ উদ্যোগ চালু করেছে। বাংলাদেশের জন্য এটি সময়োপযোগী ও জরুরি একটি পদক্ষেপ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

বিশেষজ্ঞদের মত—‘শিশুদের ভবিষ্যৎ গঠনে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ’

বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, পুষ্টিবিদ এবং উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরা এ কর্মসূচিকে “শিশুদের ভবিষ্যতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ” হিসেবে দেখছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পুষ্টিবিজ্ঞানী বলেন—
“নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার পেলে শিশুদের বৃদ্ধি দ্রুত হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং জ্ঞানীয় উন্নয়ন ঘটে। স্কুল মিল কর্মসূচি শুধু ক্ষুধা মেটানোর প্রকল্প নয়—এটি একটি মানবসম্পদ উন্নয়ন কর্মসূচি।”

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যারা উপস্থিত ছিলেন

গুরুদাসপুর উপজেলা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভা ও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন—

  • প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মো. মাসুদ রানা
  • প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান
  • অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আতিকুর রহমান
  • নাটোরের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক আরিফ হোসেন
  • ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের আবাসিক প্রতিনিধি ও কান্ট্রি ডিরেক্টর ডোমেনিকো স্কালপেলি
  • প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ

এ ছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরাও অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

গ্রামীণ বিদ্যালয়ে নতুন প্রাণ—অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া

উদ্বোধনী দিনে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে দেখা গেছে উৎসাহ ও উচ্ছ্বাস।

একজন অভিভাবক বলেন—
“আমাদের অনেক সময় বাচ্চাদের টিফিন দেওয়ার মতো সামর্থ্য থাকে না। এখন যদি স্কুল থেকে নিয়মিত খাবার দেয়, তাহলে বাচ্চারা নিয়মিত স্কুলে যাবে।”

একজন শিক্ষক বলেন—
“এ কর্মসূচি শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়াতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি হবে।”

ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের ভূমিকা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

এই বৃহৎ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (WFP) শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকারের কারিগরি সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করছে।

ডব্লিউএফপি এর আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী—

  • খাদ্য নিরাপত্তা
  • সরবরাহব্যবস্থা
  • গুণগতমান নিয়ন্ত্রণ
  • পুষ্টিমান নিশ্চিতকরণ

এসব বিষয়ে পরামর্শ এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করবে।

তাদের প্রতিনিধি ডোমেনিকো স্কালপেলি বলেন—
“বাংলাদেশের শিশুদের ভবিষ্যৎ গঠনে এই কর্মসূচির গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের পাশে থাকবো।”

সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ—জেলাভিত্তিক সরবরাহ ও গুণগতমান নিশ্চিত করা

শিক্ষাবিদদের মতে, এ কর্মসূচির সফলতার জন্য যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা জরুরি—

  1. নিয়মিত ও সময়মতো খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করা
  2. খাদ্যের গুণগতমান বজায় রাখা
  3. গ্রামীণ এলাকার লজিস্টিক সীমাবদ্ধতা সমাধান
  4. দুর্নীতি ও অপব্যবহার রোধ করা
  5. বিদ্যালয়ভিত্তিক পর্যবেক্ষণ জোরদার করা

সরকার জানিয়েছে, প্রতিটি বিদ্যালয়, ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে নিয়মিত মনিটরিং করা হবে।

ভবিষ্যৎ লক্ষ্য—সারা দেশে বিস্তৃত ‘জাতীয় মিড-ডে মিল কর্মসূচি’

প্রাথমিকভাবে ১৫০টি উপজেলায় চালু হলেও, সরকারের লক্ষ্য ধীরে ধীরে সারা দেশে এ কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা।

যদি এই প্রকল্পের ফলাফল ইতিবাচক হয়—

  • শিশুদের পুষ্টির উন্নতি
  • উপস্থিতি বৃদ্ধি
  • ঝরেপড়া কমে যাওয়া
  • শেখার ফলাফল বৃদ্ধি

তাহলে ‘জাতীয় মিড-ডে মিল’ কর্মসূচি সারাদেশেই স্থায়ীভাবে চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় নতুন মাইলফলক যুক্ত হলো ‘মিড-ডে মিল’। দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এখন প্রতিদিন নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার পাবে—যা তাদের শারীরিক বৃদ্ধি, মানসিক বিকাশ এবং শিক্ষা কার্যক্রমে সাফল্যের ওপর সরাসরি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।

শিক্ষাবিদদের ভাষায়,
“আজকের এই বিনিয়োগ ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে আরও সমৃদ্ধ, শক্তিশালী ও মানবসম্পদে সমৃদ্ধ করে তুলবে।”

MAH – 13817 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button