বাংলাদেশের তরুণ সমাজের অনুপ্রেরণার এক উজ্জ্বল নাম এখন আব্দুল্লাহ আল রাসেল। কৃষক পরিবারের সন্তান হয়েও নিজের অদম্য পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও আত্মবিশ্বাসের জোরে তিনি অর্জন করেছেন এক অসাধারণ সাফল্য। দেশের অন্যতম কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা বিসিএস (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস)-এর শিক্ষা ক্যাডারে প্রথম স্থান অর্জন করে তিনি প্রমাণ করেছেন—পরিশ্রম আর মেধা থাকলে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীও পারে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করতে।
গ্রামের সাধারণ ঘর থেকে শুরু
কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার চরফরাদী ইউনিয়নের ঝাউগারচর গ্রামের এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্ম রাসেলের। বাবা সায়েম উদ্দিন পেশায় কৃষক, আর মা কমলা খাতুন গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই রাসেলের একটাই স্বপ্ন—একদিন শিক্ষক হবেন, জ্ঞান বিতরণ করবেন সমাজে।
সীমিত আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তার পরিবার কখনোই ছেলের শিক্ষায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। প্রতিদিন স্কুলের পাশাপাশি মাঠে বাবার কাজের সহায়তা করেও রাসেল পড়াশোনায় ছিলেন অত্যন্ত মনোযোগী। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই তার শিক্ষাজীবনের যাত্রা শুরু।
মাদ্রাসা শিক্ষার গর্ব
বাংলাদেশের অনেকেই মনে করেন মাদ্রাসা থেকে মূলধারার শিক্ষায় সফল হওয়া কঠিন। কিন্তু রাসেল এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছেন। তিনি পড়াশোনা শুরু করেন মির্জাপুর আলিম মাদ্রাসায়। ২০১৪ সালে দাখিল পরীক্ষায় মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পান তিনি। এরপর ২০১৬ সালে আলিম পরীক্ষায় অর্জন করেন জিপিএ-৪.৬৪। তার এই ধারাবাহিক ফলাফলই পরবর্তীতে তাকে পৌঁছে দেয় দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন যাত্রা
মাদ্রাসার গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াই ছিল তার জীবনের বড় মোড়। তিনি ভর্তি হন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। এই বিভাগ থেকেই ২০২১ সালে অনার্স এবং ২০২২ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন যথাক্রমে সিজিপিএ ৩.৩৩ ও ৩.৩৫ নিয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে রাসেল কেবল ভালো ছাত্রই ছিলেন না; তিনি ছিলেন চিন্তাশীল, আত্মবিশ্বাসী ও অধ্যবসায়ী। ক্লাসের পাশাপাশি তিনি বিসিএস প্রস্তুতিও চালিয়ে যান। অর্থের টানাপোড়েন থাকা সত্ত্বেও কখনো হাল ছাড়েননি। তিনি জানতেন, কঠোর পরিশ্রমই তার একমাত্র হাতিয়ার।
বিসিএসের পথে সংগ্রাম ও সফলতা
৪৯তম বিশেষ বিসিএস ছিল রাসেলের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) আয়োজিত এই পরীক্ষায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আবেদন করেন ৩ লাখ ১২ হাজারেরও বেশি প্রার্থী। প্রাথমিক বাছাইয়ে উত্তীর্ণ হন মাত্র ১ হাজার ২১৯ জন। এরপর লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ৬৬৮ জন প্রার্থী চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হন।
এই বিশাল প্রতিযোগিতার মধ্যে রাসেল শুধু উত্তীর্ণই হননি, বরং শিক্ষা ক্যাডারের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেন। পিএসসি ১১ নভেম্বর রাতে ফল প্রকাশ করলে সবার আগে উঠে আসে কিশোরগঞ্জের এই তরুণের নাম।
আবেগঘন প্রতিক্রিয়া
নিজের সাফল্যের অনুভূতি জানাতে গিয়ে রাসেল বলেন,
“আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ, যিনি আমাকে এই অবস্থানে পৌঁছানোর তৌফিক দিয়েছেন। আমার পরিবার ও শিক্ষকদের উৎসাহ ছাড়া এই সাফল্য সম্ভব হতো না। মাদ্রাসা থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পথটা সহজ ছিল না। কিন্তু আমি কখনো হাল ছাড়িনি।”
তিনি আরও বলেন, “আমি কৃষকের সন্তান। ছোটবেলা থেকেই বাবার ঘাম ঝরতে দেখেছি। সেই ঘামই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে কঠোর পরিশ্রম করতে। আমি বিশ্বাস করি, পরিশ্রম করলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।”
তরুণদের উদ্দেশে বার্তা
বিসিএসে প্রথম হওয়ার পর দেশের তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে রাসেল বলেছেন,
“আমি চাই, গ্রামের মেধাবী ছেলেমেয়েরা যেন নিজেদের অযোগ্য ভাবা বন্ধ করে। মাদ্রাসা বা গ্রামীণ প্রেক্ষাপট কোনো বাধা নয়। মনোযোগ ও অধ্যবসায় থাকলে সাফল্য আসবেই। আমি তারই উদাহরণ।”
তার মতে, আজকের তরুণদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আত্মবিশ্বাসের অভাব। তিনি বলেন, “অনেকে ভাবে সুযোগ শুধু শহরের সন্তানদের জন্য। কিন্তু আমি চাই সবাই জানুক—গ্রাম থেকেও সেরা হওয়া সম্ভব, যদি ইচ্ছা থাকে।”
শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন
রাসেল বলেন, “শিক্ষা ক্যাডারে প্রথম হওয়া আমার কাছে কেবল একটি পদ নয়; এটি আমার জীবনের স্বপ্ন পূরণ। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছে ছিল। আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষা দিয়ে সমাজ পরিবর্তন করা যায়। আমি সেই কাজটাই করতে চাই।”
তিনি ভবিষ্যতে মাদ্রাসা শিক্ষার মানোন্নয়নেও কাজ করতে চান। “আমি চাই, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও যেন সমান সুযোগ পায়। তাদের মধ্যেও অনেক মেধা আছে, শুধু প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা ও সুযোগের,” বলেন রাসেল।
রাসেলের শিক্ষক ও সহপাঠীদের প্রতিক্রিয়া
রাসেলের এই সাফল্যে আনন্দে ভাসছে পুরো গ্রাম। তার মাদ্রাসার শিক্ষকরা বলেন, “রাসেল ছোটবেলা থেকেই খুব মেধাবী ও পরিশ্রমী। আমরা জানতাম, একদিন সে বড় কিছু করবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও তার প্রশংসা করেছেন। বিভাগের এক শিক্ষক জানান, “রাসেল অত্যন্ত মনোযোগী ছাত্র ছিল। তার সাফল্য মাদ্রাসা শিক্ষার জন্যও একটি বড় ইতিবাচক বার্তা।”
সহপাঠীরা বলছে, “রাসেল কখনো সময় নষ্ট করত না। ক্লাস, নোট আর বই—এই ছিল তার জগৎ। সে আমাদের অনুপ্রেরণা।”
পরিবারের আবেগঘন প্রতিক্রিয়া
রাসেলের মা কমলা খাতুন বলেন, “আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই বই নিয়ে পড়ে থাকত। আমরা চেয়েছিলাম, সে যেন বড় মানুষ হয়। আল্লাহ আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছেন।”
বাবা সায়েম উদ্দিনের চোখে জল। তিনি বলেন, “আমি কৃষিকাজ করে ছেলেকে পড়িয়েছি। আজ সে দেশের প্রথম হয়েছে—এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছু নেই।”
গ্রামের মানুষের গর্ব
পুরো ঝাউগারচর গ্রামে এখন উৎসবের আমেজ। রাসেলের নাম উচ্চারণ করলেই সবার চোখে আনন্দের ঝিলিক। কেউ বলছে, “রাসেল আমাদের গ্রামের গর্ব।” কেউ আবার বলছে, “সে প্রমাণ করেছে মাদ্রাসার ছাত্ররাও পারে দেশ বদলাতে।”
বিসিএস বিশেষ পরিসংখ্যান ও তাৎপর্য
বাংলাদেশে বিসিএস পরীক্ষা এখন স্বপ্নের চাকরি পাওয়ার সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা। প্রতিবার লাখো প্রার্থী অংশ নেন, কিন্তু সফল হন অল্প কয়েকজন। ৪৯তম বিশেষ বিসিএস মূলত শিক্ষা ক্যাডারে শূন্য পদ পূরণের জন্য অনুষ্ঠিত হয়।
পিএসসি সূত্রে জানা যায়, মোট ৬৮৩টি শিক্ষা ক্যাডারের পদে প্রার্থী নিয়োগ দেওয়া হবে। এর মধ্যে রাসেল প্রথম স্থান অধিকার করে নজির স্থাপন করেছেন।
এই ফলাফল প্রমাণ করে, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রমেই অন্তর্ভুক্তিমূলক হচ্ছে। মাদ্রাসা, সাধারণ ও কারিগরি—সব ধারার শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে মেধাবীরা এখন জাতীয় পর্যায়ে উঠে আসছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
রাসেল বলেন, “আমি চাই শিক্ষক হিসেবে এমন কিছু করতে, যাতে শিক্ষার্থীরা অনুপ্রাণিত হয়। আমি গবেষণায় যুক্ত হতে চাই ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে আধুনিক প্রেক্ষাপটে তুলে ধরতে।”
তিনি আরও জানান, “আমার সাফল্য যদি অন্তত একজন তরুণকে পড়াশোনায় আগ্রহী করে তোলে, তাহলেই আমার পরিশ্রম সফল।”
সমাজে ইতিবাচক প্রভাব
রাসেলের গল্প শুধু একটি ব্যক্তিগত সাফল্যের কাহিনি নয়; এটি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি। গ্রামীণ এলাকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখন নতুন আত্মবিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে—যে তারা চাইলে দেশের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।
কিশোরগঞ্জের রাসেলের গল্প শেখায়, সফলতার জন্য দরকার নয় শহর, ধন বা প্রভাব—দরকার কেবল ইচ্ছাশক্তি, পরিশ্রম ও বিশ্বাস।
তার এই অর্জন শুধু পরিবারের নয়, গোটা দেশের গর্ব।
রাসেলের মতো তরুণরাই প্রমাণ করছে—বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সোনালি হাতে গড়া হচ্ছে।
MAH – 13774 I Signalbd.com



