শিক্ষা

ইবতেদায়ী শিক্ষকদের মিছিলে পুলিশের হামলা, আহত ৪৩

Advertisement

জাতীয়করণের দাবিতে রাজধানীতে আন্দোলনরত ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষকদের উপর পুলিশের লাঠিচার্জ, জলকামান ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের ঘটনায় অন্তত ৪৩ জন শিক্ষক আহত হয়েছেন। বুধবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে সচিবালয় অভিমুখে শিক্ষকদের বিক্ষোভ মিছিল শুরু হলে পুলিশ মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

শিক্ষকদের দাবি, তারা সরকারের দেওয়া জাতীয়করণের ঘোষণা বাস্তবায়নের দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করছিলেন। কিন্তু বিনা উসকানিতে পুলিশ আক্রমণ চালায়। অপরদিকে, পুলিশ বলছে—তারা আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে বাধ্য হয়েই এই পদক্ষেপ নিয়েছে।

ঘটনার বিস্তারিত

বুধবার দুপুর ২টা ১০ মিনিটে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে বিক্ষোভকারীরা সচিবালয়ের দিকে যাত্রা শুরু করেন। শিক্ষকরা “দ্রুত জাতীয়করণ চাই”, “আমরা শিক্ষক, ভিক্ষুক নই”, “ন্যায্য দাবি মানতে হবে”—এই স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। মিছিল সচিবালয়ের কাছাকাছি পৌঁছালে পুলিশ বাধা দেয় এবং মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ শুরু করে।
সঙ্গে ব্যবহার করা হয় জলকামান ও অন্তত সাতটি সাউন্ড গ্রেনেড।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হঠাৎ হামলার কারণে মিছিলে থাকা বহু শিক্ষক আহত হন। কেউ মাথায়, কেউ হাতে-পায়ে আঘাত পান। আহতদের অনেককেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক জানান, “আমরা এখন পর্যন্ত ৪৩ জন আহত শিক্ষককে চিকিৎসা দিয়েছি। তাদের মধ্যে অন্তত ৮ জনের অবস্থা গুরুতর।”

শিক্ষক নেতাদের বক্তব্য

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা জাতীয় শিক্ষক ফোরামের সভাপতি ও আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক শেখ নজরুল ইসলাম মাহবুব বলেন,

“আমরা শান্তিপূর্ণভাবে দাবি জানাতে বের হয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ অপ্রত্যাশিতভাবে আমাদের উপর হামলা চালিয়েছে। ঠিক কতজন আহত হয়েছেন, তা এখনো বলা যাচ্ছে না, তবে তালিকা প্রস্তুত হচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “সরকার জানুয়ারিতে ইবতেদায়ী মাদ্রাসা জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু এখনো কোনো অগ্রগতি নেই। আমরা কেবল সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চাই।”

অন্যদিকে, মিছিলের নেতৃত্ব দেন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষক ঐক্যজোট আন্দোলন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক শামসুল আলম, সদস্য সচিব মোহাম্মদ আল আমিন, এবং বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি কাজী মোখলেছুর রহমান
তাদের দাবি, এই আন্দোলন কোনো দলীয় নয়, বরং দেশের লাখো নিম্নবেতনভোগী ও অবহেলিত শিক্ষক সমাজের ন্যায্য প্রাপ্য আদায়ের সংগ্রাম।

শিক্ষকদের ৫ দফা দাবি

১. পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণের দ্রুত বাস্তবায়ন:
সরকার চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি ইবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলো পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু তার বাস্তবায়ন এখনো শুরু হয়নি। শিক্ষকরা দ্রুত পদক্ষেপ চান।

২. এমপিওভুক্তির অনুমোদন:
কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ থেকে প্রেরিত ১০৮৯টি প্রতিষ্ঠানের ফাইল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে যাচাই-বাছাই শেষে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। শিক্ষকরা চান, এই ফাইলগুলো দ্রুত অনুমোদন দিয়ে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হোক।

৩. অনুদানবিহীন মাদ্রাসার এমপিও আবেদন:
স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কিন্তু অনুদানবিহীন মাদ্রাসাগুলোর জন্য দ্রুত এমপিও আবেদন আহ্বান করতে হবে।

৪. প্রাক-প্রাথমিক পদ সৃষ্টি:
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসাতেও প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির জন্য পদ সৃষ্টি ও নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।

৫. আলাদা অধিদপ্তর গঠন:
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিদপ্তরের মতো ইবতেদায়ী মাদ্রাসার জন্যও একটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তর গঠনের দাবি জানানো হয়েছে।

পুলিশের অবস্থান

ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,

“শিক্ষকরা অনুমতি ছাড়া সচিবালয়ের দিকে মিছিল নিয়ে যাচ্ছিলেন। আমরা তাদের থামাতে অনুরোধ করি। কিন্তু তারা বাধা অমান্য করে এগিয়ে গেলে লাঠিচার্জ করা হয়।”

তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে বলপ্রয়োগ করা গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল।

ইবতেদায়ী শিক্ষকদের দুরবস্থা

বাংলাদেশে প্রায় ১৮ হাজারের বেশি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা রয়েছে, যেখানে কর্মরত আছেন প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষক
এর মধ্যে অনেকেই মাসে মাত্র ৩,০০০ থেকে ৬,০০০ টাকা ভাতা পান।
যেসব মাদ্রাসা অনুদানবিহীন, তাদের শিক্ষকরা কোনো সরকারি সুবিধাই পান না। ফলে ন্যায্য প্রাপ্য না পেয়ে তারা বছরের পর বছর মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

অনেক শিক্ষক বলেন, “আমরা দেশের শিশুদের প্রাথমিক ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দিচ্ছি, অথচ আমাদের জীবনে কোনো স্থিতি নেই। সরকারি শিক্ষকরা যেভাবে সুবিধা পান, আমরাও সেই মর্যাদা চাই।”

সরকারের অবস্থান

সরকার এর আগে জানিয়েছিল, পর্যায়ক্রমে ইবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলো জাতীয়করণ করা হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করে।
তবে বাজেট সংকট, প্রশাসনিক জটিলতা ও যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার কারণে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন,

“আমরা বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখছি। তবে বাজেট অনুমোদন ও আইনগত কাঠামো নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।”

সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতোমধ্যে ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।
অনেকেই পুলিশি হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছেন।
শিক্ষক সমাজকে ‘দেশের বিবেক’ হিসেবে উল্লেখ করে অনেক নাগরিক মন্তব্য করেছেন—
“যেখানে শিক্ষককে লাঠিপেটা করা হয়, সেখানে শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।”

মানবাধিকার কর্মী ও বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের উচিত শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি পূরণ করা, কারণ শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি এই শিক্ষক সমাজের উপরই দাঁড়িয়ে আছে।

পূর্বের আন্দোলন ও ইতিহাস

ইবতেদায়ী শিক্ষকদের এই আন্দোলন নতুন নয়।
গত কয়েক বছর ধরে তারা বিভিন্ন সময়ে রাজধানীতে কর্মসূচি পালন করেছেন।
২০২৩ সালে একই দাবিতে তারা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে টানা ৭ দিন অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছিলেন।
সেসময় সরকার জাতীয়করণের আশ্বাস দিলেও, বাস্তবে তা আলোর মুখ দেখেনি।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

শিক্ষাবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন,

“ইবতেদায়ী স্তরের শিক্ষা হলো প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম ধাপ। এখানে যারা শিক্ষকতা করছেন, তারা যদি অনুপ্রেরণা হারান বা বঞ্চিত হন, তাহলে প্রাথমিক শিক্ষার মানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

তিনি আরও বলেন, “জাতীয়করণ শুধু বেতন নয়, এটি একটি মর্যাদার প্রতীক। সরকার চাইলে ধাপে ধাপে অন্তত আংশিক জাতীয়করণের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান করতে পারে।”

ইবতেদায়ী শিক্ষকদের আন্দোলন বাংলাদেশের শিক্ষা কাঠামোর গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি।
একদিকে শিক্ষকেরা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠনের দায়িত্ব পালন করছেন, অন্যদিকে নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা ও ন্যায্য প্রাপ্যের জন্য রাজপথে নামতে হচ্ছে।

সরকারের উচিত দ্রুত তাদের দাবিগুলো পর্যালোচনা করা ও আলোচনার মাধ্যমে টেকসই সমাধান বের করা।
কারণ, যে জাতি তার শিক্ষককে সম্মান দিতে জানে না, সে জাতির ভবিষ্যৎ কখনোই উজ্জ্বল হতে পারে না।

MAH – 13544 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button