শিক্ষা

শিক্ষার পচন রোধে শুধু কমিশন যথেষ্ট নয়: উপদেষ্টা

Advertisement

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এত গভীর সংকট ও অব্যবস্থা তৈরি হয়েছে যে, কেবল একটি নতুন শিক্ষা কমিশন গঠন করেই সমস্যার সমাধান হবে না বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তাঁর মতে, দেশের শিক্ষা কাঠামোর ভেতরে যে নৈতিক, প্রশাসনিক ও মানগত পচন ধরেছে, সেটি যদি মূল থেকে না সরানো যায়, তবে যত কমিশনই গঠন করা হোক না কেন, শিক্ষা খাতে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে না।

রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে আয়োজিত ‘ইউথ পারসপেকটিভস অন স্যোশাল প্রগ্রেস: গ্রাসরুটস, নেটওয়ার্কস অ্যান্ড লিডারশিপ ভয়েসেস’ শীর্ষক জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। এই সম্মেলনের আয়োজন করে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)

“শিক্ষায় এমন পচন ধরেছে যে কমিশন নয়, প্রয়োজন ভিত্তিগত সংস্কার”

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে কেবল কয়েকজন বিশেষজ্ঞ নিয়ে কমিশন গঠন করলেই হবে না। শিক্ষায় এত গভীর পচন ধরেছে যে, মৌলিক জায়গাগুলো ঠিক না করলে শিক্ষা কমিশন করেও কোনো লাভ হবে না।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা যখন দায়িত্ব নিয়েছি, তখন দেশের ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অভিভাবকবিহীন ছিল। এই সংকট শুধু প্রশাসনিক নয়, এটি মানেরও সংকট। শিক্ষা কমিশন দিয়ে এসব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়, কারণ এটি একটি কাঠামোগত ও নৈতিক সমস্যা।”

পরিকল্পনা উপদেষ্টা স্মরণ করিয়ে দেন, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে ইতিমধ্যে তিনটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে—কুদরাত-ই-খুদা কমিশন (১৯৭৪), মওলানা মনিরুজ্জামান মিয়া কমিশন (১৯৮৮), এবং কাইফুল্লাহ কমিশন (২০০৩)। প্রতিটি কমিশনের প্রতিবেদনে অসাধারণ ও বাস্তবসম্মত সুপারিশ ছিল। কিন্তু সেগুলোর বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। “পুরোনো রিপোর্টগুলো উপেক্ষা করে নতুন কমিশন গঠনের অর্থ কী?”—এই প্রশ্নও তোলেন তিনি।

তরুণ প্রজন্মের মানসিক অস্থিরতা: কারণ ও করণীয়

ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে তরুণদের মধ্যে একধরনের মানসিক অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তিনি এই অস্থিরতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন জুলাই মাসে সংঘটিত রাজনৈতিক আন্দোলনের সময়ের নৃশংসতা ও সহিংসতার দৃশ্য, যা তরুণদের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

তিনি বলেন, “যাঁরা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই দেশের জন্য কিছু করতে চান। কিন্তু কিভাবে করবেন, সেই পথনির্দেশনা তাঁদের কাছে পরিষ্কার নয়। এই জায়গায় প্রবীণ প্রজন্মের দায়িত্ব হচ্ছে তরুণদের পাশে দাঁড়ানো, তাঁদের পথ দেখানো।”

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মতে, তরুণদের এই শক্তিকে যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে বাংলাদেশ আবারও বিশ্বে এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারবে। কিন্তু যদি তরুণ সমাজ হতাশা ও বিভ্রান্তিতে হারিয়ে যায়, তাহলে দেশের উন্নয়ন সম্ভাবনাও বাধাগ্রস্ত হবে।

অবরোধ রাজনীতি ও ইতিবাচক পরিবর্তনের দিক

পরিকল্পনা উপদেষ্টা তরুণদের আন্দোলনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই দিকই তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “অস্থিরতার একটি নেতিবাচক দিক হলো, দাবি আদায়ের জন্য রাস্তাঘাট অবরোধ করা, যা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তবে ভালো দিকও রয়েছে—আগের মতো গাড়ি ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগ এখন আর দেখা যাচ্ছে না। এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন।”

তাঁর মতে, বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণআন্দোলনের ইতিহাসে সহিংসতার সংস্কৃতি একসময় গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। কিন্তু এখন তরুণরা সেই ধ্বংসাত্মক পথ থেকে সরে এসে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিজেদের দাবি উপস্থাপন করছে, যা গণতন্ত্রের জন্যও ইতিবাচক লক্ষণ।

বাংলাদেশে ‘ইয়ুথ পাওয়ার’ বা জনসংখ্যার সুবিধাজনক সময়

ড. মাহমুদ বলেন, “বাংলাদেশ এখন এমন এক পর্যায়ে রয়েছে, যেখানে জনসংখ্যার বেশিরভাগ অংশই তরুণ। এটি এক ধরনের ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’। এই সুযোগ প্রায় ১৫ বছর আগে শুরু হয়েছে এবং আরও ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। এই সময়টাই আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”

তিনি বলেন, “এই সময়ে তরুণদের নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে, শিক্ষাকে ব্যবহারিক ও কর্মমুখী করতে হবে, এবং একই সঙ্গে দেশ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ এই সময় পার হয়ে গেলে আমরা আর এ রকম সুযোগ পাব না।”

শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রয়োজন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মতে, শিক্ষার মান উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে অদক্ষতা, দুর্নীতি ও দায়িত্বহীনতা। তিনি বলেন, “আমরা এখন এমন এক অবস্থায় আছি যেখানে শিক্ষকের পেশাগত নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ, শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছে না, এবং প্রশাসনিক দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অচল হয়ে পড়ছে।”

তিনি জোর দিয়ে বলেন, “শিক্ষায় বিনিয়োগ মানে শুধু বাজেট বাড়ানো নয়; বরং মানসম্মত শিক্ষক তৈরি, গবেষণা সংস্কৃতি গড়ে তোলা, এবং শিক্ষাকে সমাজ ও কর্মবাজারের সঙ্গে যুক্ত করা।”

শিক্ষায় সংস্কারের জন্য প্রস্তাবিত দিকনির্দেশনা

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় টেকসই পরিবর্তন আনতে হলে নিচের বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে—

  1. শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
  2. গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বাড়ানো।
  3. শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ ও সৃজনশীল চিন্তা গড়ে তোলা।
  4. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন নিশ্চিত করা।
  5. শিক্ষার মান নির্ধারণে স্বচ্ছ মূল্যায়নব্যবস্থা গড়ে তোলা।

তরুণদের শক্তিকে ইতিবাচক পথে ব্যবহারের আহ্বান

পরিকল্পনা উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যের শেষাংশে তরুণদের উদ্দেশে বলেন, “বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তোমাদের হাতে। তাই হতাশ না হয়ে ইতিবাচকভাবে চিন্তা করো, সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করো, এবং সমাজে নেতৃত্ব দেওয়ার মানসিকতা গড়ে তোলো।”

তিনি আরও যোগ করেন, “আজকের তরুণ যদি সৎ, নীতিনিষ্ঠ ও কর্মদক্ষ হয়, তাহলে আগামী ২০ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাবে।”

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা যে ক্রমেই জটিল ও পচনগ্রস্ত হয়ে পড়ছে, তা এখন আর গোপন নয়। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের বক্তব্য যেন সেই গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি। তিনি যে সতর্কবার্তা দিয়েছেন—শিক্ষায় মৌলিক সংস্কার ছাড়া কোনো কমিশনই কার্যকর হবে না—তা শুধু নীতিনির্ধারকদের নয়, গোটা জাতির জন্যও চিন্তার বিষয়।

তরুণ প্রজন্ম এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। যদি তাদের সঠিকভাবে প্রস্তুত করা যায়, তাহলে বাংলাদেশ শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, গোটা বিশ্বেই এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।

MAH – 13538 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button