শিক্ষা

হিজাব-বোরখা নিয়ে রাবি শিক্ষকের ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য; শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

Advertisement

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হিজাব ও বোরখা পরিহিত নারী প্রতিনিধিদের ছবি নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে উত্তাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীদের দাবি, শিক্ষককে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে এবং প্রশাসনের উচিত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাতভর বিক্ষোভ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) হিজাব ও বোরখা পরিহিত নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক শিক্ষকের ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। সোমবার (২৮ অক্টোবর ২০২৫) রাত ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় শত শত শিক্ষার্থী বিক্ষোভে অংশ নেন।
তাদের দাবি— ইসলামী পোশাক নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করা শিক্ষকের বিরুদ্ধে দ্রুত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে এবং তাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।

ঘটনার সূত্রপাত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ-আল মামুনের একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টকে কেন্দ্র করে। তিনি নবনির্বাচিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) ও হল সংসদের নারী প্রতিনিধিদের শপথ অনুষ্ঠানের একটি ছবি পোস্ট করেন, যেখানে কয়েকজন নারী প্রতিনিধি বোরখা ও হিজাব পরিহিত ছিলেন।

বিতর্কিত ফেসবুক পোস্টে তোলপাড়

অধ্যাপক আ-আল মামুনের ওই পোস্টে লেখা ছিল,
“এই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আমি এন্ডোর্স করছি। কাল আমি এরকম ব্যক্তিগত স্বাধীনতা পরে ও হাতে নিয়ে ক্লাসে যাবো। পরবো টু-কোয়াটার, আর হাতে থাকবে মদের বোতল। মদ তো ড্রাগ না! মদ পান করার লাইসেন্সও আমার আছে! শিবির আইসেন, সাংবাদিকরাও আইসেন!”

পোস্টের সঙ্গে তিনি রাকসুর নারী প্রতিনিধিদের ছবি যুক্ত করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি পোস্টটি মুছে ফেলেন, তবে তার আগেই স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন শিক্ষার্থী ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গ্রুপে। দ্রুতই বিষয়টি ভাইরাল হয়ে যায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

“পর্দার অবমাননা মেনে নেওয়া যায় না” — শিক্ষার্থীদের বক্তব্য

বিক্ষোভ চলাকালীন রাকসুর মহিলা সম্পাদক সায়েদা হাফসা বলেন,
“আমরা নারী হয়েও হিজাব পরি, বোরখা পরি— এটা আমাদের ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। কিন্তু একজন শিক্ষক যখন এমন কটূ মন্তব্য করেন, তখন তা শুধু আমাদের নয়, সমগ্র মুসলিম নারীদের অস্তিত্বে আঘাত। শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিদের ছবি ব্যবহার করে এমন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না। তাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত তাকে বহিষ্কার করা।”

তিনি আরও বলেন, “হিজাব বা বোরখা কোনো সমাজবিরোধী কাজ নয়। এটি নারীর শালীনতা ও নিরাপত্তার প্রতীক। অথচ একজন শিক্ষক সেটিকে নিয়ে হাস্যরস করছেন— এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।”

রাকসুর সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন আম্মারের হুঁশিয়ারি

রাকসুর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) সালাউদ্দিন আম্মার বলেন,
“যদি তার মেরুদণ্ড সোজা থাকে, তাহলে তিনি বিভাগে টু-কোয়াটার ও মদের বোতল নিয়ে ক্লাসে আসুন, আমরা দেখবো। অন্যথায় প্রশাসন তাকে শোকজ করুক। তিন সেকেন্ড বা তিন মিনিট— পোস্ট যতক্ষণই থাকুক না কেন, এটি শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে।”

তিনি আরও বলেন, “এই ছবিতে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব ছিল না; এখানে ছিল শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত বোনেরা। তাই এটি শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের বিষয়। আমরা এই অপমানের প্রতিকার চাই।”

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি প্রশাসনের নজরে এসেছে এবং প্রাথমিকভাবে তদন্তের প্রস্তুতি চলছে।

প্রশাসনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “অধ্যাপক আ-আল মামুনের পোস্টটি সত্যিই দুঃখজনক। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছি। শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করা হতে পারে।”

শিক্ষক সমাজের প্রতিক্রিয়া

অধ্যাপক আ-আল মামুনের সহকর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ প্রকাশ্যে কিছু না বললেও অনেক শিক্ষক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন,
“বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমাদের উচিত শিক্ষার্থীদের সম্মান করা, তাদের ধর্মীয় বা ব্যক্তিগত পোশাক নিয়ে বিদ্রূপ করা নয়।”

অন্যদিকে, কিছু শিক্ষক বিষয়টিকে “মতপ্রকাশের স্বাধীনতা” হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, “যদি কেউ ধর্মীয় পোশাককে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন, তাহলে একজন শিক্ষকও নিজের মতামত ব্যক্ত করার অধিকার রাখেন।”

তবে অধিকাংশ শিক্ষকই মনে করছেন, “শিক্ষক সমাজের সদস্য হিসেবে এমন পোস্ট দায়িত্বহীনতা ও অনভিপ্রেত আচরণ।”

সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়ার ঝড়

ঘটনার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা সামাজিক মাধ্যমে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
একজন সাবেক শিক্ষার্থী লিখেছেন,
“একজন শিক্ষক যদি নারী শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় পোশাক নিয়ে ব্যঙ্গ করেন, তাহলে তিনি শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা হারান।”

আরেকজন বলেন,
“এটি কেবল হিজাব বা বোরখার বিষয় নয়, এটি একজন নারীর সম্মান, বিশ্বাস ও নিরাপত্তার বিষয়। একজন শিক্ষক যখন এই সীমা অতিক্রম করেন, তখন তা শিক্ষাক্ষেত্রের জন্য অশুভ সংকেত।”

বিক্ষোভে শিক্ষার্থীদের দাবিসমূহ

বিক্ষোভে শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দাবি উত্থাপন করেন—
১. অধ্যাপক আ-আল মামুনকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।
২. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অবিলম্বে তদন্ত কমিটি গঠন করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩. ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার কারণে তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে হবে।
৪. বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার সংক্রান্ত আচরণবিধি প্রণয়ন করতে হবে।

ধর্মীয় পোশাক নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়

বাংলাদেশে হিজাব ও বোরখা নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পোশাকটি একদিকে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতীক, অন্যদিকে কিছু মহলে তা সামাজিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক নারী শিক্ষার্থী স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে হিজাব বা বোরখা পরেন, আবার কেউ কেউ তা না পরার স্বাধীনতাও উপভোগ করেন। কিন্তু একপক্ষ অন্য পক্ষকে অপমান করলে তা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, হিজাব বা বোরখা কোনো ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা হোক বা ব্যক্তিগত পছন্দ— এটি নিয়ে কটূ মন্তব্য বা অবমাননা সমাজে বিভাজন তৈরি করে এবং নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও আত্মবিশ্বাসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় সহনশীলতার গুরুত্ব

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অন্যতম প্রাচীন ও মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এমন স্থানে একজন শিক্ষকের দায়িত্ব অনেক বেশি।
একজন শিক্ষক কেবল পাঠদানের মাধ্যম নন, তিনি শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণার প্রতীকও। তাই তার বক্তব্য বা আচরণ যখন বিতর্ক সৃষ্টি করে, তখন তা পুরো শিক্ষাঙ্গনকে প্রভাবিত করে।

শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধর্মীয় সহনশীলতা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার প্রয়োজন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

এই ঘটনাটি শুধুমাত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মুহূর্ত নয়, বরং বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রতিফলন। হিজাব, বোরখা বা অন্য যে কোনো পোশাকই হোক— প্রত্যেকেরই নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী বাঁচার অধিকার রয়েছে।

একজন শিক্ষকের দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের সম্মান করা, নয় অবমাননা করা। তাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আ-আল মামুনের এই মন্তব্য কেবল বিতর্কই নয়, বরং একটি সতর্কবার্তা— শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কটূক্তি নয়, সহনশীলতা ও সম্মানই হওয়া উচিত মৌল ভিত্তি।

MAH – 13519 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button