
২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে পাসের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৫৮.৮৩ শতাংশে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফলাফলের এই বিপর্যয় শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি, সিলেবাস ও পরীক্ষার বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কিত।
পরীক্ষার ফলাফলের সারসংক্ষেপ
২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৬১ জন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে পাস করেছেন ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ জন, আর ফেল করেছেন ৫ লাখ ৮ হাজার ৭০১ জন শিক্ষার্থী। মোট জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৭ জন।
শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যে ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৬৪.৬২ শতাংশ, রাজশাহীতে ৫৯.৪০, কুমিল্লায় ৪৮.৮৬, যশোরে ৫০.২০, চট্টগ্রামে ৫২.৫৭, বরিশালে ৬২.৫৭, সিলেটে ৫১.৮৬, দিনাজপুরে ৫৭.৪৯, ময়মনসিংহে ৫১.৫৪, মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডে ৭৫.৬১ এবং কারিগরি শিক্ষাবোর্ডে ৬২.৬৭ শতাংশ।
কেন এত কম পাসের হার?
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফলাফলের এই পতন শিক্ষার্থীদের যথাযথ প্রস্তুতির অভাব, সম্পূর্ণ সিলেবাসের পরীক্ষা, এবং বাস্তব ভিত্তিক মূল্যায়নের ফল। কোভিড-১৯ পরবর্তী বছরগুলোতে অতিরিক্ত জিপিএ-৫ প্রদানের ফলে শিক্ষার্থীরা বাস্তবতাকে বুঝতে পারেননি। এবারের ফলাফলে সেই বাস্তব চিত্র স্পষ্ট হয়েছে।
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. তোহিদুল ইসলাম বলেন, ইংরেজিতে শিক্ষার্থীরা খারাপ করেছে। এই বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
প্রধান বিষয় ও পরীক্ষার প্রস্তুতি
এইচএসসি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশি ফেল হয়েছে হিসাববিজ্ঞান, ইংরেজি এবং আইসিটি বিষয়ে। হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে ফেল করেছেন ৪১.৪৬ শতাংশ, ইংরেজিতে ৩৮.৮ শতাংশ এবং আইসিটি-তে ২৭.২৮ শতাংশ শিক্ষার্থী।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশ্নপত্রের ধরন পরিবর্তন এবং খাতার মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে কাজ করেছে। শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি ও মনোযোগ বৃদ্ধি না পাওয়ায় ফলাফল প্রভাবিত হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক প্রভাব
প্রায় ২০২টি কলেজে সব শিক্ষার্থী ফেল করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত এবং শিক্ষার্থীরা পরিবারের সঙ্গে কাজ করতে বাধ্য। এর ফলে নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিতি কমে গেছে।
কলেজ অধ্যক্ষ হিমাদ্রি রায় বলেন, আর্থিক সমস্যার কারণে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত হতে পারেনি। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সীমিত সম্পদও ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
বুয়েট, এনএসইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. হাসানুজ্জামান বলেছেন, এবারের ফলাফল শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সক্ষমতা প্রতিফলিত করছে। অতিরিক্ত জিপিএ-৫ প্রদানের সংস্কৃতি এখন বন্ধ হয়েছে। শিক্ষার্থীদের শেখার বিকল্প নেই, শিক্ষক ও অভিভাবকদেরও শিক্ষা কার্যক্রমের মান উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, আধুনিক শিক্ষাদানের কলাকৌশল এবং প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়ন শিক্ষার্থীদের ফলাফল উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
শিক্ষার বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আববার বলেন, এবারের ফলাফল বাস্তবভিত্তিক। অতিরঞ্জিত ফলাফল প্রদানের সংস্কৃতি বন্ধ করে শিক্ষার মান বাড়ানোই লক্ষ্য। শিক্ষা বোর্ডগুলো শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার্থীদের মনোযোগ বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ নেবে।
বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, এবারের বাস্তব ফলাফল শিক্ষার্থীদের শেখার প্রতি দায়িত্বশীল করবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মসংস্থানের মান উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলার মাধ্যমে ভবিষ্যতে আরও ভালো ফলাফল আসবে।
২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাসের হার কমে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করাই ভবিষ্যতে ভালো ফলাফলের মূল চাবিকাঠি।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শিক্ষাব্যবস্থার এই বাস্তবতা গ্রহণ করলে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে আরও সক্ষম হবে। ফলাফল বিপর্যয় নয়, বরং শিক্ষার মানোন্নয়নের সুযোগ হিসেবে দেখা উচিত।
এম আর এম – ১৮১৭,Signalbd.com