শিক্ষা

ভর্তি হওয়ার পরে সবার বিয়ে হয়ে গেছে, এ জন্য কেউ পাস করতে পারেনি

Advertisement

পঞ্চগড় জেলার তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেউই এবার এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। শিক্ষা প্রশাসনের তদন্তের মুখে পড়েছে বোদা পাইলট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ তিনটি কলেজ। এরই মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বক্তব্যে নেটদুনিয়ায় শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনা।

২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর দেখা যায়, পঞ্চগড় জেলার তিনটি কলেজ থেকে কেউই পাস করতে পারেনি। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই স্থানীয়ভাবে সমালোচনা শুরু হয়। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে বোদা পাইলট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নার্গিস পারভিন মৌসুমীর বক্তব্য—

“ভর্তি হওয়ার পরে সবার বিয়ে হয়ে গেছে, এ জন্য কেউ পাস করতে পারেনি।”

পঞ্চগড়ের তিন কলেজে শতভাগ অকৃতকার্য

শিক্ষা বোর্ডের প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী, পঞ্চগড় জেলার তিনটি প্রতিষ্ঠানের কেউই পাস করতে পারেনি। এগুলো হলো— বোদা উপজেলার বোদা পাইলট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, একই উপজেলার মাড়েয়া মডেল হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ, এবং তেঁতুলিয়া উপজেলার আলহাজ্ব তমিজ উদ্দীন কলেজ
বোদা পাইলট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মোট ১২ জন শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে ৪ জন অনুপস্থিত ছিলেন। মাড়েয়া মডেল হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাত্র ১ জন এবং আলহাজ্ব তমিজ উদ্দীন কলেজ থেকে ৪ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেয়, যাদের মধ্যে ২ জন উপস্থিত ছিল।

“ভর্তি হওয়ার পরে সবার বিয়ে হয়ে গেছে”—ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের মন্তব্যে বিতর্ক

বোদা পাইলট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নার্গিস পারভিন মৌসুমীর ব্যাখ্যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন,
“আমাদের কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে বেশিরভাগ মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। কেউ আর নিয়মিত ক্লাসে আসেনি। তাই পরীক্ষায় কেউ পাস করতে পারেনি।”
তার এই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে শিক্ষামহলে আলোচনা শুরু হয়েছে—এমন পরিস্থিতি কেবল শিক্ষার্থীদের দায় নয়, বরং শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতাকেও তুলে ধরে।

শিক্ষক সংকট ও এমপিওভুক্ত না হওয়ায় স্থবিরতা

স্থানীয় সূত্র জানায়, এই তিনটি কলেজের কোনোটি এখনো এমপিওভুক্ত নয়। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক সংকট, স্থায়ী নিয়োগ না থাকা এবং পরিকাঠামোগত দুর্বলতা শিক্ষার মানে বড় প্রভাব ফেলেছে।
মাড়েয়া মডেল হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সপেন্দ্রনাথ বর্মণ বলেন,
“আমাদের কলেজ শাখা এখনো এমপিওভুক্ত হয়নি। কয়েক বছর ধরে কোনো শিক্ষকই নেই। একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিলেও পাস করতে পারেনি, কারণ ক্লাসে নিয়মিত পড়াশোনার পরিবেশ নেই।”

প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া—তদন্তের নির্দেশ

পঞ্চগড় জেলার ভারপ্রাপ্ত জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা খায়রুল আনাম মো. আফতাবুর রহমান হেলালী বলেন,
“যেসব প্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করতে পারেনি, তাদের শোকজ করা হবে। কেন এমন ফলাফল হলো, তা খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। প্রয়োজনে নতুন শিক্ষক নিয়োগ বা বিশেষ একাডেমিক সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি আরও জানান, জেলা প্রশাসনের নির্দেশে তিনটি কলেজের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় পুনরায় আগ্রহী করতে বিশেষ সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু করা হবে।

স্থানীয়দের অভিমত—গ্রামীণ এলাকায় মেয়েদের শিক্ষায় বড় বাধা বাল্যবিয়ে

স্থানীয় অভিভাবক ও সমাজকর্মীরা বলছেন, গ্রামীণ এলাকায় মেয়েদের শিক্ষাজীবন সবচেয়ে বেশি ব্যাহত হয় বাল্যবিয়ের কারণে।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার বাসিন্দা ও শিক্ষাবিদ ফারহানা সুলতানা বলেন,
“মেয়েরা একবার কলেজে ভর্তি হলেও পরিবার থেকে দ্রুত বিয়ের চাপ আসে। ফলে তাদের পড়াশোনা মাঝপথে থেমে যায়। এই প্রবণতা বন্ধ না করলে ভবিষ্যতে আরও এমন ফলাফল দেখা যাবে।”
তিনি মনে করেন, বিদ্যালয় পর্যায়ে মেয়েদের ধরে রাখতে সামাজিক সচেতনতা ও অর্থনৈতিক সহায়তা দুটোই জরুরি।

আগের বছরগুলোতেও দুর্বল ফলাফল

তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো গত কয়েক বছর ধরেই দুর্বল ফল করছে। ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে বোদা পাইলট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে পাসের হার ছিল যথাক্রমে ৩৫ ও ২২ শতাংশ। এবার পুরোপুরি শূন্য ফলাফল শিক্ষাপ্রশাসনের জন্য উদ্বেগজনক ইঙ্গিত।
বিশ্লেষকদের মতে, শিক্ষক সংকট, ক্লাসে অনুপস্থিতি, বাল্যবিয়ে ও অনুপ্রেরণার অভাব—সব মিলিয়ে শিক্ষার মান ক্রমেই নিম্নমুখী হয়েছে।

বিশেষজ্ঞ মত—“শুধু দায় চাপিয়ে লাভ নেই, ব্যবস্থা নিতে হবে”

শিক্ষাবিষয়ক বিশ্লেষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন,
“একজন অধ্যক্ষের ‘বিয়ে হয়ে গেছে তাই পাস করেনি’—এমন বক্তব্য শুনে হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু এর পেছনে সামাজিক বাস্তবতা আছে। এখন সময় এসেছে এই বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার। স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সমন্বয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন,
“যদি শিক্ষক সংকট থাকে, তাৎক্ষণিকভাবে ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দিন। মেয়েদের জন্য আলাদা প্রণোদনা দিন, না হলে আগামী বছরও একই ফল হবে।”

ভবিষ্যৎ করণীয়

শিক্ষা বোর্ড ইতিমধ্যে তিনটি কলেজের ফলাফল বিশ্লেষণ শুরু করেছে। প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের ৮০ শতাংশই নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত ছিল না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, “এমন প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ একাডেমিক সহায়তা ও রেমিডিয়াল প্রোগ্রাম চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।”
স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে নতুন করে অভিযান জোরদারের কথাও বলা হয়েছে।

পঞ্চগড়ের তিন কলেজের এইচএসসি পরীক্ষায় শূন্য ফলাফল কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়—এটি দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থার সংকটের প্রতিচ্ছবি। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বক্তব্য হয়তো অদ্ভুত শোনায়, কিন্তু তার মধ্যে লুকিয়ে আছে বাস্তবতা—শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ, শিক্ষক সংকট ও সামাজিক চাপ।
তদন্তের ফলাফল ও পরবর্তী পদক্ষেপই বলে দেবে, এই শূন্য ফলাফল থেকে শিক্ষা প্রশাসন কতটা শিক্ষা নিতে পারে

এম আর এম – ১৮০৭,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button