
শুরু হলো চাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) দীর্ঘ প্রতীক্ষিত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন আজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। বুধবার (১৫ অক্টোবর ২০২৫) সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা চলবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।
এই নির্বাচনের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার শিক্ষার্থীর হাতে ফেরত এলো বহু কাঙ্ক্ষিত ভোটাধিকার, যা গত তিন যুগ ধরে স্থগিত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন, কারণ ৩৪ বছর পর পুনরায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে চাকসু নির্বাচন।
শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাসে মুখর ক্যাম্পাস
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ আজ সকাল থেকেই উৎসবের আবহে মুখরিত। ক্যাম্পাসের প্রতিটি অনুষদ ভবনের সামনে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সারি, হাতে ভোটার স্লিপ, গলায় পরিচয়পত্র— যেন এক প্রাণবন্ত গণতান্ত্রিক উৎসব।
অনেক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা জীবনে প্রথমবার ভোট দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নির্বাচনে। চবি শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম বলেন,
“আমরা শুধু বইয়ে পড়েছি চাকসুর ইতিহাস, কিন্তু আজ নিজে ভোট দিতে পারছি— এটা আমাদের জন্য অনেক গর্বের।”
অন্যদিকে, ছাত্রী সুমি আক্তার বলেন,
“এমন নির্বাচন আমাদের ক্যাম্পাসে অনেক আগে হওয়া উচিত ছিল। এখন মনে হচ্ছে, আমরা সত্যিই বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ।”
কোথায় হচ্ছে ভোটগ্রহণ
ভোটগ্রহণ চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি অনুষদ ভবনে। সেগুলো হলো—
১. কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ ভবন
২. সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ভবন
৩. বিজ্ঞান অনুষদ ভবন
৪. ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ভবন
৫. আইন অনুষদ ভবন
প্রতিটি কেন্দ্রে নির্বাচনী কর্মকর্তারা উপস্থিত রয়েছেন, পাশাপাশি রয়েছে স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া তদারকি।
প্রার্থীর সংখ্যা ও পদের বিবরণ
চাকসু ও হল সংসদ মিলিয়ে মোট ৯০৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে চাকসুতে ২৬টি পদে ৪১৫ জন এবং হল সংসদে ৪৯৩ জন প্রার্থী লড়ছেন।
- মোট ভোটার: ২৭,৫১৭ জন
- ছাত্র: ১৬,০৮৪ জন
- ছাত্রী: ১১,৪৩৪ জন
চাকসু কেন্দ্রীয় সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৮ জন নারী প্রার্থী ও ৩৬৬ জন পুরুষ প্রার্থী। এছাড়া ২৪ জন প্রার্থী ইতিমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
প্রধান তিনটি পদে প্রার্থীর সংখ্যা:
- ভিপি (সভাপতি): ২৪ জন
- জিএস (সাধারণ সম্পাদক): ২২ জন
- এজিএস (সহ-সাধারণ সম্পাদক): ২১ জন
হল সংসদের ক্ষেত্রে, ছাত্রদের ৯টি হল ও একটি হোস্টেল থেকে ৩৫০ জন প্রার্থী, এবং ছাত্রীদের ৫টি হল থেকে ১২৩ জন প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকসু নির্বাচন সর্বশেষ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯০ সালের ৬ জুলাই। এরপর রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশাসনিক জটিলতা ও নীতিমালা সংশোধনের অজুহাতে চাকসু নির্বাচন আর অনুষ্ঠিত হয়নি।
দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীরা নির্বাচন পুনরায় চালুর দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন। ২০২৪ সালের শেষের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নতুন করে চাকসু সংবিধান সংস্কার করে, যা নির্বাচন আয়োজনের পথ সুগম করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক চর্চা পুনরুজ্জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
রাজনীতি বিশ্লেষক ড. নূরুল হাসান বলেন,
“চাকসু নির্বাচন শুধু নেতৃত্ব তৈরির জায়গা নয়, এটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অনুশীলনের ক্ষেত্রও। দীর্ঘ বিরতির পর এই নির্বাচন তরুণদের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখবে।”
নির্বাচনী প্রচারণা ও পরিবেশ
নির্বাচন ঘোষণার পর থেকেই ক্যাম্পাসে শুরু হয় জমজমাট প্রচারণা। বিভিন্ন সংগঠন ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ক্যাম্পাসে মিছিল, পোস্টার, পথসভা এবং প্রচার-সংগীতের মাধ্যমে ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যাচ্ছে দুটি প্রধান ছাত্র সংগঠন ও কয়েকটি স্বতন্ত্র প্যানেলের মধ্যে। তবে পুরো প্রচারণা তুলনামূলক শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
চবি প্রোক্টর অধ্যাপক ড. রবিউল হাসান বলেন,
“আমরা শুরু থেকেই চাইছিলাম একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। সব পক্ষই সহযোগিতা করেছে, তাই ক্যাম্পাসে এখনো শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে।”
আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
নির্বাচনকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ, র্যাব, আনসার ও নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীরা মোতায়েন রয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে চলছে তল্লাশি, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের আগে শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র যাচাই করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান,
“আমরা চাই এই নির্বাচন উৎসবমুখর পরিবেশে সম্পন্ন হোক। এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে আছেন।”
প্রশাসনের প্রস্তুতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার
চাকসু নির্বাচনে এবার প্রথমবারের মতো ডিজিটাল ভোটার তালিকা ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিটি ভোটারকে আলাদা ভোটার নম্বর দেওয়া হয়েছে, যা ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে যাচাই করা হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। ভোট গণনা শেষে ফলাফল প্রকাশ করা হবে কেন্দ্রীয়ভাবে, যেখানে সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীরা উপস্থিত থাকতে পারবেন।
শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা
দীর্ঘ বিরতির পর চাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের কাছে শুধু রাজনৈতিক ইভেন্ট নয়, এটি নেতৃত্বের একটি নতুন দ্বার খুলে দিচ্ছে।
শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বলেন,
“চাকসু থাকলে আমাদের সমস্যাগুলো প্রশাসনের কাছে পৌঁছে দেওয়া সহজ হয়। যেমন- পরিবহন সংকট, হলের সমস্যা, কিংবা শিক্ষার মান— এসব বিষয়ে ছাত্রদের কণ্ঠস্বর হবে চাকসু।”
অন্যদিকে, ছাত্রীদের আশা— এই নির্বাচনের মাধ্যমে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়বে।
ছাত্রী রেশমা আক্তার বলেন,
“৪৮ জন নারী প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন, এটি একটি ইতিবাচক দিক। ভবিষ্যতে চাকসুর নেতৃত্বে আরও নারীরা আসুক— এটাই আমাদের প্রত্যাশা।”
ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ মনে করছেন, এই নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও ছাত্রকল্যাণে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
চবি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আফসার উদ্দিন বলেন,
“যদি নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দায়িত্বশীলভাবে কাজ করেন, তাহলে চাকসু হতে পারে শিক্ষার্থীদের স্বার্থরক্ষার সবচেয়ে কার্যকর মঞ্চ।”
তিনি আরও বলেন,
“আমরা চাই, চাকসু শুধু রাজনীতির কেন্দ্র না হয়ে শিক্ষার্থীদের কল্যাণমূলক কার্যক্রমের মডেল হয়ে উঠুক।”
সমাপ্তি ভাবনা
তিন যুগ পর অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন শুধু ভোটের আয়োজন নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক পুনর্জাগরণ।
গণতন্ত্র, অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব তৈরির যে সংস্কৃতি একসময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব ছিল, সেই ধারা পুনরায় ফিরে আসছে এই নির্বাচনের মাধ্যমে।
সন্ধ্যায় ভোটগ্রহণ শেষে শুরু হবে গণনা। রাতেই প্রাথমিক ফলাফল ঘোষণা করার প্রস্তুতি রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।
সবশেষে বলা যায়— আজকের দিনটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে, কারণ আজ শিক্ষার্থীদের হাতে ফিরেছে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার— ভোটের অধিকার।
MAH – 13316 I Signalbd.com