
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবারও দেশের উচ্চশিক্ষার ইতিহাসে গৌরবময় অবস্থান ধরে রাখল। যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বনামধন্য শিক্ষা সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন (THE) প্রকাশ করেছে ২০২৬ সালের বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিং, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) গত বছরের তুলনায় এক লাফে ২০০ ধাপ এগিয়ে এসেছে। এর মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণ হলো ঢাবি শুধু দেশের নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় শক্ত অবস্থান তৈরি করছে।
বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ঢাবির নতুন অবস্থান
গত বছর (২০২৫ সালের র্যাঙ্কিংয়ে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ১০০১ থেকে ১২০০-এর মধ্যে। এ বছর বিশ্ববিদ্যালয়টি উঠে এসেছে ৮০১ থেকে ১০০০-এর মধ্যে। অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিংয়ে এ বছর মোট ৩,১১৮টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। শিক্ষা, গবেষণার পরিবেশ, গবেষণার মান, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং শিল্পক্ষেত্রের সহযোগিতা—এই পাঁচটি সূচক ধরে মূল্যায়ন করা হয়েছে।
সূচকভিত্তিক অগ্রগতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির প্রধান কারণ হলো গবেষণা ও শিক্ষার মানোন্নয়নে দৃশ্যমান সাফল্য।
- গবেষণার পরিবেশ সূচক: আগের বছরের তুলনায় ৩ পয়েন্ট বেড়েছে (১০.৩ → ১৩.৩)।
- গবেষণার মান সূচক: ৯.৩ পয়েন্ট উন্নতি (৬৭.২ → ৭৬.৫)।
- শিল্পক্ষেত্রের সঙ্গে সহযোগিতা সূচক: ১১.৮ পয়েন্ট বৃদ্ধি (২১.৪ → ৩৩.২)।
- শিক্ষা সূচক: বর্তমানে ১৭.৭।
- আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি সূচক: বর্তমানে ৪৫।
এ অগ্রগতি প্রমাণ করে যে ঢাবি শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, শিল্প ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতায়ও ক্রমে অগ্রসর হচ্ছে।
সাফল্যের পেছনে কমিটির ভূমিকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব র্যাঙ্কিং উন্নয়নের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে একটি বিশেষ ১৬ সদস্যের কমিটি কাজ করছে। উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের নেতৃত্বে কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উন্নয়নে কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আছেন প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ। এছাড়া প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. এম জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুস সালামসহ বিভিন্ন অনুষদের প্রখ্যাত অধ্যাপকরা এতে যুক্ত আছেন।
তাদের উদ্যোগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা, আন্তর্জাতিক প্রকাশনা, শিক্ষার্থীদের গবেষণামূলক কার্যক্রম ও শিল্প সহযোগিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
উপাচার্যের বক্তব্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান এ সাফল্যে আনন্দ প্রকাশ করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেন—
“এটি ঢাবির জন্য একটি ঐতিহাসিক অর্জন। আমাদের লক্ষ্য শুধু দেশের সেরা নয়, বৈশ্বিক মঞ্চেও নিজেদেরকে আরও শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করা। এই সাফল্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গবেষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল।”
QS র্যাঙ্কিংয়ে ঢাবির অবস্থান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাঙ্কিংয়েই নয়, যুক্তরাজ্যভিত্তিক আরেকটি খ্যাতনামা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডস (QS) র্যাঙ্কিংয়েও সাফল্য ধরে রেখেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, QS বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৫৮৪তম। বাংলাদেশ থেকে QS তালিকায়ও ঢাবিই সেরা।
এটি প্রমাণ করে যে দুই ভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মূল্যায়নেই ঢাবি দেশের সেরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত।
কেন র্যাঙ্কিং গুরুত্বপূর্ণ?
বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং শুধু মর্যাদার বিষয় নয়, এটি একটি দেশের উচ্চশিক্ষার মান ও গবেষণার অগ্রগতির পরিচায়ক।
- বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করা সহজ হয়।
- আন্তর্জাতিক গবেষণা অনুদান পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
- শিক্ষার্থীরা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যায়।
- বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণা ও একাডেমিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়।
ঢাবির এই অগ্রগতি বাংলাদেশকে বৈশ্বিক শিক্ষামঞ্চে আরও দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করবে।
অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় ঢাবির অবস্থান
বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান যদিও এখনও ততটা উন্নত নয়, তবে ধীরে ধীরে তারা এগিয়ে আসছে। তবে ঢাবির মতো ২০০ ধাপ একসাথে উন্নতি অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় করতে পারেনি।
ঢাবি সবসময় দেশের শিক্ষা, গবেষণা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। তাই বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে এর অগ্রগতি প্রত্যাশিত হলেও এটি দেশের জন্য একটি বড় স্বীকৃতি।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা জার্নাল প্রকাশ, বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণা এবং প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। তবে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে—
- অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা
- পর্যাপ্ত তহবিলের ঘাটতি
- আন্তর্জাতিক গবেষণায় আরও অংশগ্রহণের প্রয়োজন
- শিক্ষার্থীদের গবেষণা সহায়তার সীমিত সুযোগ
তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আশাবাদী যে এসব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে তারা আরও ভালো অবস্থানে পৌঁছাতে সক্ষম হবে।
টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাঙ্কিংয়ে ঢাবির ২০০ ধাপ এগিয়ে আসা শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন নয়, বরং বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার সামগ্রিক অগ্রগতির প্রতীক। দেশের শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নিজেদের প্রমাণ করতে পারছে, এবং ভবিষ্যতে আরও উন্নত গবেষণা ও শিক্ষা সুযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ে আরও উঁচুতে উঠবে—এটাই প্রত্যাশা।
MAH – 13249 I Signalbd.com