
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের জ্বলন্ত অবস্থা দিনে দিনে আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। ঈদুল আজহার আনন্দের মধ্যেও গাজাবাসীর মুখে নেই কোন হাসি, নেই খাবার বা প্রয়োজনীয় ত্রাণের স্বস্তি। ইসরায়েলি বিমান হামলায় একদিনেই প্রাণ হারিয়েছেন ৮২ জন ফিলিস্তিনি, যাদের মধ্যে ৩৯ জন গাজা সিটির বাসিন্দা। এই খবর নিশ্চিত করেছে কাতারি সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা।
গাজা সিটি আরও একবার ধ্বংসের আগুনে
গত রোববার রাতে স্থানীয় সময় প্রায় রাত ২টার দিকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) গাজা শহরের শেখ রেদওয়ান এলাকায় একটি আবাসিক ভবনে বিমান হামলা চালায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, বিস্ফোরণের তীব্রতা এতোটাই ছিল যে, অনেকের দেহ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে। এই হামলাকে গাজাবাসী ‘প্রলয়ংকরী’ আখ্যা দিয়েছেন।
মাহমুদ আল শেখ নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী আল-জাজিরাকে বলেছেন, “বিস্ফোরণের ভয়াবহ আওয়াজে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরও একবার বিস্ফোরণ হয়। আমরা দ্রুত দৌড়ে বের হয়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত দুজনকে উদ্ধার করি। চারটি পরিবার সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেছে।”
গাজা থেকে আল-জাজিরার প্রতিনিধি হানি মাহমুদ জানান, “বর্তমানে গাজার প্রতি ইসরায়েলের আচরণ অনেক বেশি কঠোর এবং নিষ্ঠুর। সাম্প্রতিক বিমান হামলাগুলো এত ভয়ংকর যে, ২০২৩ সালের অক্টোবরের যুদ্ধের শুরুয়াতের সময়ের ঘটনা মনে পড়ে। মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে সাতটি বিমান হামলা চালানো হয়েছে।”
মানবিক বিপর্যয়, কমিউনিটি কিচেনে হামলা
শুধু আবাসিক এলাকা নয়, গাজার গুরুত্বপূর্ণ মানবিক কেন্দ্রগুলোকেও লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে। ডেইর আল বালাহ এলাকায় অবস্থিত একটি স্থানীয় কমিউনিটি কিচেনও হামলার শিকার হয়েছে। সেখানে কাজ করা কমিউনিটি কিচেনের প্রধান অপারেটর এবং তিন জন স্বেচ্ছাসেবী নিহত হয়েছেন। এই কমিউনিটি কিচেন গাজার দুর্যোগগ্রস্ত মানুষের খাবারের অন্যতম প্রধান উৎস।
ত্রাণ নিতে গিয়ে নিহত ৩৯ জন
গাজা শহরের বাইরে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে ত্রাণ নিতে গিয়ে রোববার আরও ৩৯ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। চলতি বছরের মে মাসে গাজায় কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে এই সংগঠনটির ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে প্রাণহানি বেড়েই চলেছে। এখন পর্যন্ত জিএইচএফের ত্রাণ কেন্দ্রে নিহতের সংখ্যা ৭৪৩ জনে পৌঁছেছে।
বিশ্বজুড়ে এই হামলার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় বয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে ইসরায়েল-মার্কিন সমর্থিত এই সংগঠনটির কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গাজার বর্তমান সংকট ও বিশ্বমঞ্চের প্রতিক্রিয়া
গাজার অবরুদ্ধ অবস্থা এবং নিয়মিত ইসরায়েলি বিমান হামলা ও সেনা অভিযান স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। পানীয় জল, খাবার, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ সংকট গ্রাস করেছে গাজাকে। চলমান সংঘর্ষের কারণে অসহায় সাধারণ মানুষ প্রত্যেক দিন প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতির সম্মুখীন।
বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং জাতিসংঘ এই সংকটের অবিলম্বে সমাধান চেয়ে আহ্বান জানিয়ে আসছে। তবে ইসরায়েলি পক্ষের কড়া নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক জটিলতার কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো কী বলছে?
আমেরিকার হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা গাজার অবরুদ্ধ অবস্থা এবং ইসরায়েলের বিমান হামলা কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছে। তারা বলছে, “গাজার বেসামরিক জনসংখ্যা নিরাপদ রাখার জন্য আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তৎপরতা বাড়াতে হবে। অবরুদ্ধ এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে।”
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু এখনও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
গাজা সংকটের ইতিহাস সংক্ষেপে
গাজা উপত্যকা মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে সংকটাপন্ন এলাকা। ২০০৭ সাল থেকে হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। অবরুদ্ধ গাজায় বসবাসরত প্রায় দুই কোটি ফিলিস্তিনি জীবনযাত্রার চরম সংকটে পড়েছেন। বিভিন্ন সময়ে বড় বড় যুদ্ধ সংঘটিত হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হামলাগুলো আরও বিধ্বংসী হয়েছে।
গাজার সাধারণ মানুষের দুর্দশা ও ভবিষ্যত
ঈদুল আজহার আনন্দের দিনেও গাজার মানুষের মুখে হাসি নেই, নেই শান্তি। তারা শুধু বেঁচে থাকার জন্য ত্রাণের অপেক্ষায়। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ, পানীয় জলের সংকট, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত, এসব কারণে প্রতিটি দিন তাদের জন্য নতুন সংকট নিয়ে আসছে।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহানুভূতি এবং কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া গাজার অবস্থা আরো দারুণ অবনতির দিকে যেতে পারে।