শিক্ষা

শিক্ষকের মর্যাদা বাড়ালে জাতির অগ্রগতি হবে: উপাচার্য

Advertisement

আজ ৫ অক্টোবর, বিশ্ব শিক্ষক দিবস। বিশ্বের বহু দেশে এদিনকে শিক্ষককে সম্মান জানানোর দিন হিসেবে উদযাপন করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজ এখনও আর্থিক অনিশ্চয়তা ও সামাজিক মর্যাদার সংকটে ভুগছে। শিক্ষককে জাতি গঠনের কারিগর বলা হলেও সেই কারিগররা আজ অনেকটা উপেক্ষিত।

ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শামছুল আলম এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে বলেছেন— “শিক্ষকের মর্যাদা বাড়াতে হবে, নয়তো জাতির অগ্রগতি থেমে যাবে।”

শিক্ষক: জাতি গঠনের কারিগর নাকি অবহেলিত পেশাজীবী?

শিক্ষক সমাজ সবসময়ই জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে স্বীকৃত। ইতিহাস সাক্ষী, পৃথিবীর প্রতিটি উন্নত দেশের পেছনে শিক্ষকের অবদানই ছিল প্রধান। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে শিক্ষক পেশাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়। অথচ বাংলাদেশে এখনো অনেক শিক্ষক সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খান।

অধ্যাপক ড. শামছুল আলম মনে করেন, শিক্ষক যদি ক্লাসরুমে দাঁড়িয়ে পাঠদান করেন অথচ মাথার ভেতর সংসারের দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খায়, তবে শিক্ষার্থীদের প্রতি শতভাগ মনোযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। আর মনোযোগের ঘাটতি মানেই শিক্ষার মান কমে যাওয়া।

শিক্ষা ও শিক্ষকতার বাস্তবতা

বাংলাদেশে এখনো অনেক শিক্ষক মাস শেষে বেতন পেলেই সেটাই শিক্ষকতার মূল উদ্দেশ্য মনে করেন। অথচ প্রকৃত শিক্ষকতা কেবল পাঠদান নয়, বরং শিক্ষার্থীর মানসিক, নৈতিক ও সামাজিক বিকাশের দায়িত্বও বহন করে।

ড. শামছুল আলম বলেন,
“যদি শিক্ষকরা সত্যিকার অর্থে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করতেন, তবে বাংলাদেশ আজ অনেক আগেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত।”

তিনি মনে করিয়ে দেন, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড হলেও সেটি কার্যকর হয় শিক্ষক সমাজের মাধ্যমে। একজন আদর্শ শিক্ষক শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠন করেন, জ্ঞানের আলো ছড়ান এবং তাদের সঠিক পথ দেখান।

শিক্ষকের মর্যাদা সংকট

বাংলাদেশে শিক্ষকের সামাজিক ও আর্থিক মর্যাদা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান কিংবা নেপালেও শিক্ষকরা তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় আছেন। উন্নত দেশগুলোর কথা তো বলাই বাহুল্য।

অনেক শিক্ষককে এখনো সীমিত আয়ের মধ্যে পরিবার চালাতে হয়। শহর বা গ্রামে বেশিরভাগ শিক্ষক খুব সাধারণ জীবনযাপন করেন। এ কারণে মেধাবী তরুণরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হন না।

উপাচার্যের ভাষায়—
“আমাদের দেশে শিক্ষকের মর্যাদা নেই বললেই চলে। বাস্তব সুযোগ-সুবিধাও খুব সীমিত। শিক্ষকরা পেটে-ভাতে জীবন চালান। এজন্য জাতির অগ্রগতি থেমে যাচ্ছে।”

বিশ্ব শিক্ষক দিবস: প্রেক্ষাপট

১৯৯৪ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। UNESCO ও ILO-এর যৌথ উদ্যোগে এ দিবসের সূচনা হয় শিক্ষকের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এদিন শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।

বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হলেও বাস্তবে শিক্ষকের অবস্থান কতটা সম্মানজনক—এ প্রশ্ন থেকেই যায়।

শিক্ষাজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা

নিজের শিক্ষাজীবনের কথা স্মরণ করে অধ্যাপক ড. শামছুল আলম বলেন,
“আমার প্রাক্তন অনেক শিক্ষক শুধু ক্লাসরুমেই নয়, বরং জীবনের নানা ক্ষেত্রে আমাকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। কারো কাছে বই পড়ার পদ্ধতি শিখেছি, কারো কাছ থেকে জীবনের মূলনীতি। তাঁদের অনুপ্রেরণা ছাড়া আমি আজকের জায়গায় আসতে পারতাম না।”

তিনি মনে করেন, নতুন প্রজন্মের কাছে এই শিক্ষকের অবদান তুলে ধরা জরুরি। কারণ শিক্ষকই শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস, ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব গড়ে তোলেন।

আর্থিক নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিতকরণ জরুরি

শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা না থাকলে তারা শিক্ষার্থীদের জন্য মনোযোগ দিতে পারেন না। মাস শেষে সংসারের খরচ মেটানো যদি শিক্ষকের প্রধান দুশ্চিন্তা হয়, তবে শিক্ষা কার্যক্রম কখনোই মানসম্মত হবে না।

উপাচার্য বলেন,
“যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও ধরে রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য সুবিধা ও মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে। সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে আরও অনেক যোগ্য মানুষ শিক্ষকতায় আসবে।”

ইসলামী শিক্ষার ভূমিকা

ড. শামছুল আলম বিশেষভাবে ইসলামী শিক্ষার গুরুত্বের ওপর জোর দেন। তার মতে, শিক্ষা কেবল জ্ঞান অর্জন নয়, বরং এটি মন, শরীর ও আত্মার সুষম বিকাশ। ইসলামী শিক্ষা সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ধরে রাখে। তাই রাষ্ট্রকে শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে।

শিক্ষকের প্রকৃত অর্জন কী?

শিক্ষকের বড় বাড়ি বা দামি গাড়ি না থাকলেও তাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো শিক্ষার্থীর সম্মান। একবার এক ছাত্র নিজের সিট ছেড়ে তাকে বসতে দিয়েছিল—এই ছোট্ট ঘটনার উদাহরণ টেনে ড. শামছুল আলম বলেন, “এটাই শিক্ষকের সবচেয়ে বড় অর্জন।”

জাতীয় উন্নয়নে শিক্ষকের অবদান

বাংলাদেশের উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে শিক্ষক সমাজকে মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। ইতিহাসে দেখা যায়, যেসব জাতি শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে, তারাই দ্রুত উন্নতি করেছে।

শিক্ষক যদি আন্তরিকভাবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলেন, তবে সেই শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবে। রাষ্ট্র, সমাজ ও জাতি তিনটিই সমৃদ্ধ হবে।

শিক্ষক দিবসে উপাচার্যের আহ্বান—
“চলুন আমরা জাতির সন্তানদের জন্য নিজেদের সম্পূর্ণ উজাড় করি। তাদের মানসিক ও নৈতিক বিকাশে অংশ নিই। যদি আমরা আন্তরিকভাবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলি, তবে জাতি ও দেশ উভয়ই সমৃদ্ধ হবে—এটাই শিক্ষকের প্রকৃত জয়।”

MAH – 13160 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button