
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পাবিপ্রবি) সম্প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা জারি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ঘোষণা করেছে যে, ভাইভা, প্রেজেন্টেশন বা অন্যান্য একাডেমিক কার্যক্রমের সময় নারী শিক্ষার্থীদের নিকাব খুলতে বাধ্য করা যাবে না। শিক্ষার্থীদের পরিচয় শনাক্তের দায়িত্ব এখন শুধুমাত্র নারী শিক্ষিকাদের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে।
এই সিদ্ধান্তটি এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিজন কুমার ব্রহ্ম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে, যা ১৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ ব্যবস্থা চালু না হওয়া পর্যন্ত কোনো নারী শিক্ষার্থীকে তার নিকাব খুলতে বাধ্য করা যাবে না।
নারী শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা ও মর্যাদার গুরুত্ব
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের এই নির্দেশনার মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত মর্যাদা রক্ষা করা। শিক্ষার্থীরা যেন তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক পরিচয় অনুসারে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে, তা নিশ্চিত করা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ আছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনো শিক্ষার্থীকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা না হয়, বিদ্রুপ বা বুলিংয়ের শিকার না হতে হয়।
বিশেষভাবে, নারী শিক্ষিকাদের মাধ্যমে পরিচয় শনাক্তকরণ ব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপ ছাড়াই পরীক্ষা বা প্রেজেন্টেশন দিতে পারে।
সারাদেশে হিজাব ও নিকাব শিক্ষার্থীদের প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদ
পাবিপ্রবির এই নির্দেশনার পেছনে রয়েছে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা। ১৪ সেপ্টেম্বর, দেশের একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব ও নিকাব পরা শিক্ষার্থীদের প্রতি হয়রানি ও হেনস্তার ঘটনা ঘটে।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে পাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের কাছে একটি স্বারকলিপি প্রদান করেন। স্বারকলিপিতে তারা তিনটি মূল দাবি তুলে ধরেন:
- শিক্ষার্থীদের শনাক্তকরণের জন্য বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু করা।
- বায়োমেট্রিক ব্যবস্থা চালু না হওয়া পর্যন্ত নারী শিক্ষিকাদের মাধ্যমে পরিচয় শনাক্তকরণ নিশ্চিত করা।
- হিজাব বা নিকাব খুলতে বাধ্য না করা এবং কোনো ধরনের বুলিং, ট্যাগিং বা বৈষম্য থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করা।
এছাড়াও, শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল শিক্ষার্থী যেন নিরাপদ ও সমান সুযোগভিত্তিক পরিবেশে শিক্ষাজীবন চালাতে পারে।
বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ: আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নিরাপত্তা
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের সঠিক পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ ব্যবস্থা খুবই কার্যকর একটি পদক্ষেপ। বায়োমেট্রিক প্রযুক্তি যেমন আঙ্গুলের ছাপ বা চেহারার স্বীকৃতি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীর পরিচয় নিশ্চিত করে।
পাবিপ্রবি প্রশাসন জানিয়েছে, যতদিন পর্যন্ত এই প্রযুক্তি কার্যকরভাবে চালু করা হবে না, ততদিন শিক্ষার্থীদের নিকাব খুলতে বাধ্য করা যাবে না। এই সময়ে নারী শিক্ষিকাদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পরিচয় যাচাই করা হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়োমেট্রিক ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা দুটোই নিশ্চিত করে। শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপবিহীন পরিবেশে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও পরিচয় যাচাইয়ের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৈষম্য রোধে প্রশাসনের উদ্যোগ
পাবিপ্রবির এই নির্দেশনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মীয় বা সামাজিক বৈষম্য প্রতিরোধ করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে, কোনো শিক্ষার্থীকে বিদ্রুপ, ট্যাগিং বা নানান ধরনের হেনস্তার শিকার হতে দেওয়া হবে না।
শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও ধর্মীয় পরিচয় ধরে রাখতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসন বলেছে যে, নামমাত্র পরিচয় যাচাইয়ের বাইরে অন্য কোনো চাপ দেওয়া যাবে না।
বিশ্ববিদ্যালয় শাসনব্যবস্থায় এটি একটি উদাহরণস্বরূপ উদ্যোগ, যা দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও অনুসরণ করা যেতে পারে।
শিক্ষার্থীদের অধিকার ও নিরাপত্তার প্রতিফলন
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পদক্ষেপ শিক্ষার্থীদের অধিকার ও নিরাপত্তার প্রতি গভীর মনোযোগ প্রদর্শন করে। নারী শিক্ষার্থীরা যাতে শিক্ষা জীবনে কোনও ধরনের অযাচিত বাধার সম্মুখীন না হয়, তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ধরনের উদ্যোগ শুধু শিক্ষার্থীদের মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে না, বরং সমাজে নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি করবে।
এছাড়াও, শিক্ষার্থীদের দাবি এবং প্রশাসনের পদক্ষেপ ধর্মীয় স্বাধীনতা ও শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় সাধনের একটি উদাহরণ।
পাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা খুশি
পাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের এই পদক্ষেপকে সাহায্যপূর্ণ এবং যুগোপযোগী বলে অভিহিত করেছেন। তারা মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা ও মর্যাদার প্রতি বিশেষ মনোযোগ তাদের পড়াশোনায় আরও মনোযোগী হতে সাহায্য করবে।
শিক্ষার্থীরা আশা করছেন, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও পাবিপ্রবির এই পদক্ষেপ অনুসরণ করবে, যাতে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি সমান অধিকার এবং নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত হয়।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নির্দেশনা শুধু একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি শিক্ষার্থীদের মানবাধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তার প্রতি প্রতিশ্রুতি।
ভবিষ্যতে যখন বায়োমেট্রিক প্রযুক্তি সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হবে, তখন শিক্ষার্থীদের পরিচয় যাচাই আরও সহজ ও নিরাপদ হবে। তার আগে, নারী শিক্ষিকাদের মাধ্যমে পরিচয় যাচাই করা হবে, যা শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপমুক্ত এবং নিরাপদ পরিবেশে একাডেমিক কার্যক্রম চালানোর সুযোগ দেবে।
এই পদক্ষেপ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে, যেখানে শিক্ষার্থীদের অধিকার, মর্যাদা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে।
পাবিপ্রবির এই উদ্যোগ দেখায় যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কেবল শিক্ষা নয়, বরং শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা ও মানবিক মর্যাদার প্রতি কতটা দায়বদ্ধ।
MAH – 12925 I Signalbd.com