
ইসরায়েলি বাহিনীর বেগবান বিমান ও জঙ্গি হামলা এখনও অব্যাহত রয়েছে ফিলিস্তিনের গাজা স্ট্রিপে। গত একদিনে মাত্র একক হামলায় অন্তত ৭৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহতের সংখ্যা অগণিত। এই ধ্বংসযজ্ঞে হাজারো পরিবার বিচ্ছিন্ন ও বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরা জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে বড় অংশই ত্রাণ সামগ্রী নিতে গিয়ে ইসরায়েলি বিমান হামলার শিকার হয়েছেন। দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহরে একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের পাশে হামলায় কমপক্ষে পাঁচজন প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া খান ইউনিস এবং বুরেইজ শরণার্থী শিবিরেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
গাজার দক্ষিণাঞ্চলে রাফাহ ও খান ইউনিসে হামলার তাণ্ডব
রাফাহ শহর, যা গাজার দক্ষিণ সীমান্তবর্তী একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত, সেখানে গত ২৪ ঘণ্টায় ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে ইসরায়েলি হামলায় ৫ জন নিহত হয়েছেন। স্থানীয় ফিলিস্তিনি সংবাদ সংস্থা ‘ওয়াফা’ এই খবর নিশ্চিত করেছে।
এছাড়া খান ইউনিস শহরের বাস্তুচ্যুত শিবিরগুলোতেও বিমান হামলা চালানো হয়েছে, যেখানে অন্তত ৯ জন মারা গেছেন এবং বহু মানুষ গুরুতর আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা সংকটাপন্ন।
বুরেইজ শরণার্থী শিবিরেও হামলা চালিয়ে একটি বাণিজ্যিক ভবনে কমপক্ষে ৪ জন নিহত হয়েছেন। এই শরণার্থী শিবিরগুলো ইতোমধ্যে গত দশকে বহুবার হামলার কবলে পড়েছে, কিন্তু চলমান এই হামলা সবচেয়ে তীব্র বলে অভিহিত করা হচ্ছে।
গাজার উত্তরাঞ্চল ও গাজা সিটিতেও চলছে মারাত্মক হামলা
ইসরায়েলি বাহিনী গাজার উত্তরাঞ্চল এবং গাজা সিটির বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় বিমান হামলা এবং স্থলবাহিনী অভিযান জোরদার করেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় উত্তর গাজা ও গাজা সিটিতে অন্তত ২৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
এই হামলায় বহু পরিবার বিধ্বস্ত হয়েছে, আর আবাসিক ভবনগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত বা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাজার নাগরিকরা এখন নিজেদের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু সন্ত্রাস ও ধ্বংসযজ্ঞের তান্ডব থেকে বাঁচা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে।
গাজার মানবিক সংকট এবং বাস্তুচ্যুত জনগণের দুঃখ-কষ্ট
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার জবাবে ইসরায়েল গাজার ওপর সামরিক অভিযান শুরু করার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৮,০০০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা লাখেরও বেশি। এই সংঘাতের কারণে গাজার অধিকাংশ বাসিন্দা নিজেদের বাড়ি ছেড়ে বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা গাজার এই সংকটকে ‘মানবতাবিরোধী দুর্যোগ’ আখ্যা দিয়েছে। ত্রাণ ও চিকিৎসাসেবা সরবরাহ সীমিত, বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের অভাব দারুণ চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, শিশুসহ অসহায় মানুষদের জীবন সংকটে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মানবিক সাহায্যের দাবি
বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক দেশ ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানেরা গাজার এই সংকটের দ্রুত সমাধান দাবি করেছে। জাতিসংঘের মুখপাত্র বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন এবং মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।
বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা গাজার বাসিন্দাদের জন্য জরুরি খাদ্য, ওষুধ ও আশ্রয় সহায়তা পাঠাচ্ছে, তবে পরিস্থিতি এতটাই সংকটপূর্ণ যে সাহায্য পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
গাজার ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
গাজা স্ট্রিপ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সংকটপূর্ণ এলাকা। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের দীর্ঘদিনের সংঘাত এখানে রূপ নিয়েছে অসংখ্য হত্যাকাণ্ড, ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক বিপর্যয়ে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েলি স্থলবাহিনী ও বেসামরিক এলাকা লক্ষ্য করে বৃহৎ আক্রমণের পর, ইসরায়েল গাজার ওপর ব্যাপক সামরিক অভিযান চালায়। এর পর থেকেই গাজায় হামলা থেমে না।
গাজার বাসিন্দারা বর্তমানে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন। ত্রাণ কার্যক্রম স্থগিত হওয়া, খাদ্য ও ওষুধের তীব্র অভাব এবং জীবনের নিরাপত্তাহীনতা তাদের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে।
গাজার সাধারণ মানুষের কষ্টের কাহিনী
গাজার ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের সামনে নিহত ত্রাণপ্রার্থী ফাতেমা আল-হাসান তার ছোট দুই সন্তানের সঙ্গে বসেছিল, যখন হঠাৎ ইসরায়েলি বিমান হামলা শুরু হয়। তিনি এবং তার দুই সন্তানসহ অনেকেই হতাহত হয়েছেন। ফাতেমার স্বামী জানান, “আমাদের কোথাও আশ্রয় নেই, বাড়ি ভেঙে গেছে, আমরা কেবল বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছি।”
অন্যদিকে, খান ইউনিস শিবিরের বাসিন্দা আহমেদ মুরাদ বলেন, “আমাদের বাড়ি ধ্বংস হয়েছে, আমরা শিবিরে চলে এসেছি, কিন্তু সেখানে নিরাপত্তাও নেই। প্রতিদিনই মৃত্যু ও ধ্বংসের খবর পাই।”
গাজায় শান্তির প্রত্যাশা ও ভবিষ্যৎ
গাজার স্থায়ী শান্তির জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের সংহতি ও সমন্বিত প্রচেষ্টা এখন সময়ের দাবি। যুদ্ধের তীব্রতা কমিয়ে আলোচনার মাধ্যমে স্থায়ী সমাধান আনাই একমাত্র পথ।
দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, গাজার জনগণ শান্তিতে বসবাসের অধিকার রাখে এবং আন্তর্জাতিকভাবে এই সংকটের অবসান হওয়া জরুরি।