
দক্ষিণ কোরিয়ায় টানা ভারী বৃষ্টিপাত ও ভূমিধসের কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ প্রাকৃতিক দূর্যোগে অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া এখনও অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন এবং উদ্ধার কাজ চলছে। স্থানীয় সময় গত বুধবার (১৬ জুলাই) থেকে শুরু হওয়া এই প্রবল বৃষ্টিপাতে দেশটির দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে দক্ষিণ কোরিয়ার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যালয় জানিয়েছে, এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এ পর্যন্ত উদ্ধার কাজ চলমান থাকায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণ ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
সাম্প্রতিক বন্যা ও ভূমিধসের মূল কারণ হিসেবে টানা কয়েকদিনের প্রবল বৃষ্টি এবং পাহাড়ি এলাকা থেকে মাটির নিচে ভর করে থাকা জলধারার অতিরিক্ত চাপকে ধরা হচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন শহর ও গ্রামে হাজার হাজার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, বন্যার পানিতে অন্তত ১০ হাজার মানুষ বাধ্য হয়ে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে সরে যেতে হয়েছে। বন্যার কারণে দেশের প্রায় ৪১ হাজার পরিবার বিদ্যুৎ ও পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, যার ফলে তাদের দৈনন্দিন জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল ও উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলগুলোতেও বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে, যার ফলে আরও ভূমিধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রাণহানির বিস্তার ও বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সানচেওং কাউন্টি, যেখানে ছয়জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে এবং সাতজন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। এছাড়া উত্তরাঞ্চলীয় পার্বত্য অঞ্চল ও পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য জায়গায়ও বন্যার কারণে প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
বন্যার পানিতে হাজার হাজার রাস্তা, সেতু ও বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে। কৃষিজমি ডুবে যাওয়ার ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, যা আগামী সময়ে খাদ্য সংকটের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। গবাদি পশুরও ব্যাপক মৃত্যু হয়েছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
সরকার ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পদক্ষেপ
দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ সতর্কতা জারি করেছে এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় একাধিক সংস্থার সমন্বয়ে বড় পরিসরে উদ্ধার ও পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করেছে।
সরকারি তথ্য মতে, বন্যা ও ভূমিধসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য জরুরি ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। রাজ্যের উদ্ধারকর্মীরা এখন পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধে পাহাড়ে বনজঙ্গল রক্ষা এবং জল নিস্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি জরুরি।
দক্ষিণ কোরিয়ার বন্যা: বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের বার্তা
দক্ষিণ কোরিয়ায় এই বন্যা ও ভূমিধস শুধু দেশটির জন্যই নয়, বরং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের একটি দৃষ্টান্ত হিসেবেও দেখা হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে অস্বাভাবিক ও প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত, বন্যা, খরা ও ভূমিধসের সংখ্যা বেড়ে গেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন জলবায়ু বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, যদি দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হয়, তাহলে এমন দুর্যোগের মাত্রা এবং ঘনত্ব আরও বাড়বে।
দক্ষিণ কোরিয়ার বন্যা: কী শিখতে পারি?
১. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পূর্বাভাস: আধুনিক প্রযুক্তি ও উপগ্রহ চিত্র ব্যবহার করে বৃষ্টিপাত ও ভূমিধসের আগাম সতর্কতা কার্যকর করতে হবে।
২. জনসচেতনতা বৃদ্ধি: দুর্যোগের সময় কীভাবে নিরাপদে থাকতে হয় এবং জরুরি অবস্থায় কী করতে হয়, তা জনসাধারণকে শিক্ষা দিতে হবে।
৩. প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা: পাহাড়ি বনাঞ্চল সংরক্ষণ ও জল নিস্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি জরুরি।
৪. ত্বরিত উদ্ধার ব্যবস্থা: দুর্যোগ মোকাবিলায় দক্ষ উদ্ধার ও ত্রাণ কর্মীদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং প্রস্তুতি নিতে হবে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় গত কয়েকদিন ধরে চলমান বন্যা ও ভূমিধস দেশের জন্য একটি বড় সংকটের সৃষ্টি করেছে। এতে অন্তত ১৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন, আরও অনেক মানুষ নিখোঁজ। দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের উদ্যোগ এবং আন্তর্জাতিক সহায়তাও জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বাড়ছে। তাই আমাদের সকলেরই উচিত সচেতন থাকা এবং পরিবেশ রক্ষায় অংশগ্রহণ করা, যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।