বিশ্ব

ইসরায়েল রাষ্ট্রদূত ফেরত, নারীদের প্রতি আচরণে দ্বন্দ্ব

Advertisement

সাম্প্রতিক এক ঘটনায় সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) কর্তৃপক্ষ ‘অগ্রহণযোগ্য’ ও ‘মর্যাদাহানিকর’ নারীবিদ্বেষী আচরণের অভিযোগে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ইয়োসি আব্রাহাম শেলিকে দেশে ফেরত পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। ২০২৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আমিরাতে পরিচয়পত্র পেশ করে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হলো, যা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের উপর নতুন সংকট ডেকে এনেছে।

ইসরায়েলের স্বনামধন্য চ্যানেল ১২ এর রিপোর্ট অনুসারে, আবুধাবির এক বারে শেলি ও তার সঙ্গীরা এমন আচরণ করেন, যা সংযুক্ত আরব আমিরাতের কর্তৃপক্ষ ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে বিবেচনা করে। এই ঘটনার পরপরই তারা স্পষ্ট জানায় যে, আর এই রাষ্ট্রদূতকে আমিরাতে গ্রহণ করা হবে না। ইসরায়েল সরকারও অবিলম্বে রাষ্ট্রদূতকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

ঘটনাপ্রবাহ ও বিবরণ: কোথায় ঘটলো বিতর্ক?

হিব্রু সংবাদমাধ্যম এন১২ জানিয়েছে, শেলি তার কয়েকজন ইসরায়েলি সহকর্মী ও নারীদের নিয়ে একটি বারে গিয়েছিলেন। সেখানে তাদের আচরণ ছিল অসভ্য ও দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। সংযুক্ত আরব আমিরাতের কর্মকর্তারা এই আচরণকে ‘মর্যাদাহানিকর’ ও ‘অগ্রহণযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

এই ঘটনায় যে নারীদের উপস্থিতি ছিল, সেটিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। কারণ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমাজে নারীদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। তাই রাষ্ট্রদূতের এই আচরণ ছিল দ্বৈরথপূর্ণ ও সংস্কৃতিগত ভেদাভেদ সৃষ্টি করতে পারে এমন।

আব্রাহাম চুক্তি ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

২০২০ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ‘আব্রাহাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়, যা মধ্যপ্রাচ্যে একটি ঐতিহাসিক কূটনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরায়েলের মধ্যে প্রথমবারের মতো পূর্ণ স্বীকৃতি ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, পর্যটন, শিক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বেড়ে ওঠে।

তবে গাজা সংঘর্ষের কারণে বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা চললেও, আবুধাবি এখনও ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ আরব মিত্র হিসেবে পরিচিত। যদিও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরায়েলের গাজায় ‘গণহত্যা’ চালানোর অভিযোগ করে আসছে।

গাজা যুদ্ধের মাঝে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিওন সার মাত্র একবার আমিরাত সফর করতে পেরেছেন, যা এই অঞ্চলে রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার প্রতিফলন।

রাষ্ট্রদূত শেলির অতীত ও বিতর্ক

ইয়োসি আব্রাহাম শেলি একজন অভিজ্ঞ কূটনীতিক, যিনি ব্রাজিলে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে তার কূটনৈতিক ক্যারিয়ারে বিতর্কও কম ছিল না।

ব্রাজিলে শেলি একটি বিতর্কিত ঘটনা নিয়ে আলোচনায় আসেন, যেখানে তিনি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর সঙ্গে নৈশভোজে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে খাবারে লবস্টার ছিল, যা ইহুদি খাদ্যবিধির বিরুদ্ধে। এই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় এবং বিতর্ক তৈরি হয়।

তারপর আরো একটি কাণ্ড ঘটে, যেখানে একজন ব্রাজিলীয় নারী ভিসার আবেদন প্রক্রিয়ায় তার সঙ্গে যোগাযোগের সময় শেলির আচরণ অস্বাভাবিক ও অনুচিত বলে অভিযোগ ওঠে। ওই নারীর ভাষ্য ছিল, শেলি ভিডিও কলে অর্ধনগ্ন অবস্থায় ছিলেন এবং ব্যক্তিগত সাক্ষাতের জন্য চাপ প্রদান করেন। এই ঘটনাটি ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করে।

এসব বাদ দিয়ে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাকে একজন দক্ষ ও পারদর্শী কূটনীতিক হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট

সংযুক্ত আরব আমিরাত একটি বহুজাতিক ও বহুসাংস্কৃতিক দেশ। যদিও দেশটির জনসংখ্যা মাত্র এক কোটি, এর প্রায় ৯০ শতাংশই বিদেশী শ্রমিক ও অভিবাসী। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমিক, ব্রিটিশ, রাশিয়ান এবং অন্যান্য দেশের প্রভাবশালী নাগরিকদের বসবাস এখানে লক্ষণীয়।

দুবাই ও আবুধাবি উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম প্রধান বিনোদন কেন্দ্র, যেখানে নাইটলাইফ, পানশালা ও বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তবে সেখানেও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা করে চলা বাধ্যতামূলক।

রাষ্ট্রদূতের আচরণ যদি দেশের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে যায়, তা কঠোর পদক্ষেপের কারণ হয়।

ইসরায়েল-আমিরাত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ: নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন

ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ফেরত পাঠানোর এই ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের কূটনৈতিক অঙ্গনে এক নতুন ইঙ্গিত বহন করছে। আব্রাহাম চুক্তির পর থেকে সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকলেও এই ধরনের ঘটনায় তা নড়বড়ে হতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, সাম্প্রতিক ঘটনার পর দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সংলাপ ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপনে কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন। বিশেষত, দুই দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা বোঝা ও সম্মান করার মাধ্যমে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা রোধ করা সম্ভব।

ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ইয়োসি আব্রাহাম শেলির ‘অগ্রহণযোগ্য’ আচরণের কারণে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কঠোর সিদ্ধান্ত কেবল একটি দেশীয় ঘটনা নয়, এটি মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা ও কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য বড় সতর্কতা।

আব্রাহাম চুক্তির সাফল্য রক্ষা ও দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য সাংস্কৃতিক সম্মান, পারস্পরিক বিশ্বাস এবং দ্বিপক্ষীয় সংলাপের বিকল্প নেই। এই ঘটনার আলোকে ভবিষ্যতে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রতিরোধে সবার সচেতনতা জরুরি।

 MAH – 12037, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button