লাইলাতুল কদরের সন্ধানে আল-আকসায় ১ লাখ ৮০ হাজার মুসল্লির নামাজ আদায়

রমজানের শেষ দশক মুসলমানদের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই সময়ের কোনো এক বেজোড় রাতে লুকিয়ে রয়েছে মহিমান্বিত লাইলাতুল কদর, যে রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এ রাতের ফজিলত ও বরকত লাভের আশায় পবিত্র আল-আকসা মসজিদে সমবেত হন লক্ষাধিক মুসল্লি। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামনায় তারা দীর্ঘ রাত ধরে নামাজ আদায় ও দোয়া করেন।
আল-আকসায় লাখো মুসল্লির সমাবেশ
পবিত্র রমজানের শেষ দশকের এক বেজোড় রাতে মুসলিম উম্মাহর হাজার হাজার মানুষ পবিত্র আল-আকসা মসজিদে জড়ো হন। ইসলামিক ট্রাস্ট (ওয়াকফ বোর্ড) জানিয়েছে, বুধবার রাতে আল-আকসায় নামাজ আদায় করেছেন প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার মুসল্লি। বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আনাদোলু এজেন্সি এই তথ্য প্রকাশ করে।
ফিলিস্তিন, জর্ডান, মিসরসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মুসল্লিরা এই রাতে আল-আকসায় অবস্থান করেন। বিশেষ করে পশ্চিম তীর ও গাজার মানুষরা এ রাতের ফজিলত অর্জনের জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মসজিদে উপস্থিত হন।
ইসরায়েলি বাধা ও মুসল্লিদের ভোগান্তি
তবে এবারের নামাজেও মুসল্লিদের ভোগান্তির শেষ ছিল না। ইসরায়েলি বাহিনী প্রতিবারের মতো এবারও মসজিদে প্রবেশের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে। পশ্চিম তীর থেকে আগত মুসল্লিরা একাধিক চেকপয়েন্ট পার হয়ে মসজিদে প্রবেশের সুযোগ পান। ইসরায়েলি বাহিনী বিভিন্ন স্থানে বাধা সৃষ্টি করায় মুসল্লিদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে।
পশ্চিম তীরের বাসিন্দা জাকিয়েহ আওয়াদ বলেন, “চেকপয়েন্ট পার হতে আমাদের তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। অনেক গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। যখন আল-আকসায় প্রবেশের অনুমতি পেলাম, তখন আমার আনন্দের সীমা ছিল না। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।”
কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং তল্লাশি সত্ত্বেও মুসল্লিরা দৃঢ় মনোবল নিয়ে আল-আকসার দিকে এগিয়ে যান। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত তারা ধৈর্যের পরীক্ষা দেন, শুধু আল্লাহর ঘরে নামাজ আদায়ের জন্য।
তারাবিহ ও বিশেষ দোয়া
আল-আকসার ভেতরে প্রবেশের পর মুসল্লিরা ইবাদতে মগ্ন হন। তারা তারাবিহসহ রাতভর নফল নামাজ আদায় করেন। অনেকে কোরআন তিলাওয়াত ও জিকির-আজকারে সময় কাটান। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের জনগণের মুক্তি, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও শান্তির জন্য দোয়া করা হয়।
গাজা উপত্যকার একজন মুসল্লি আনাস হামাদ বলেন, “গাজার নিরীহ মানুষের জন্য আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি। তারা দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়নের শিকার। আল-আকসায় দাঁড়িয়ে আমরা তাদের মুক্তির জন্য প্রার্থনা করেছি।”
ইসরায়েলি কঠোরতা ও আল-আকসায় নামাজের পরিবেশ
প্রতিবারের মতো এবারও ইসরায়েল আল-আকসায় প্রবেশের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। মসজিদের প্রবেশদ্বারগুলোর চারপাশে নিরাপত্তা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়। নামাজ আদায় করতে আসা মুসল্লিদের ব্যাপকভাবে তল্লাশি করা হয়।
এক ফিলিস্তিনি নাগরিক জানান, “আমরা দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করেছি। নামাজ পড়তে আসাটাই যেন এক যুদ্ধ। কিন্তু আমরা সব বাধা পেরিয়ে আল-আকসায় এসে ইবাদত করেছি, এটাই আমাদের জন্য বড় পাওয়া।”
আল-আকসার গুরুত্ব ও মুসলিম উম্মাহর আবেগ
আল-আকসা ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ। এটি মুসলমানদের কাছে শুধু একটি ইবাদতের স্থান নয়, বরং ইতিহাস ও আবেগের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। পবিত্র কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মেরাজের রাতে এখান থেকে আসমানে গমন করেন। তাই মুসলমানদের কাছে আল-আকসা বিশেষ মর্যাদার স্থান।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত মুসলমানরা এই মসজিদে ইবাদত করার জন্য উদগ্রীব থাকেন। কিন্তু ইসরায়েলি দখলদারিত্বের কারণে মুসলমানদের সেখানে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবুও প্রতিবছর রমজানে হাজার হাজার মানুষ কঠিন বাধা পেরিয়ে আল-আকসায় জড়ো হন।
ইসরায়েলি অবরোধ ও মুসলমানদের সংকট
ফিলিস্তিনের মুসলমানদের জন্য আল-আকসায় নামাজ আদায় করা সহজ নয়। পশ্চিম তীর ও গাজার জনগণ প্রতিনিয়ত ইসরায়েলি বাহিনীর নিপীড়নের শিকার হন। অনেক সময় তাদের আল-আকসায় প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। এই পরিস্থিতি মুসলিম বিশ্বে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরায়েলের কঠোর নীতির নিন্দা জানিয়ে আসছে। তারা বলছে, ইসরায়েলের এমন আচরণ ধর্মীয় স্বাধীনতার লঙ্ঘন। মুসলমানদের ইবাদতের অধিকার নিশ্চিত করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব।
উপসংহার
রমজানের শেষ দশকের এই রাতটি মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। লাইলাতুল কদরের সন্ধানে লক্ষাধিক মানুষ আল-আকসায় একত্রিত হয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছেন। নানা বাধা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মুসল্লিরা সেখানে উপস্থিত হয়ে ইবাদত করেছেন, যা প্রমাণ করে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও ধর্মীয় অনুভূতি।
বিশ্ব মুসলিম নেতাদের উচিত ফিলিস্তিনের মুসলমানদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হওয়া। আল-আকসার পবিত্রতা রক্ষা এবং মুসলমানদের নিরাপদে ইবাদত করার পরিবেশ নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।