৯৩৫ কোটি টাকায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা হচ্ছে ২টি জাহাজ

বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুইটি আধুনিক বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ কেনার অনুমোদন দিয়েছে। এই দুই জাহাজ কেনায় মোট ব্যয় হবে প্রায় ৯৩৫ কোটি টাকা। সরকারের মতে, এই বিনিয়োগ দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করবে।
মন্ত্রিসভার অনুমোদন
মঙ্গলবার (১২ আগস্ট ২০২৫) দুপুরে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে এই অনুমোদন দেয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
বৈঠক শেষে জানানো হয়, জাহাজগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (BSC) নিজস্ব অর্থায়নে কেনা হবে। অর্থাৎ, সরকারি বাজেটের বাইরে থেকে, করপোরেশনের নিজস্ব তহবিল ব্যবহার করে এই বিনিয়োগ করা হবে।
কেন বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ গুরুত্বপূর্ণ
বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ হল বড় আকারের মালবাহী নৌযান, যা মূলত কয়লা, শস্য, লৌহ আকরিক, সারসহ বিভিন্ন শুষ্ক পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের জন্য এই ধরণের জাহাজের গুরুত্ব অনেক:
- আমদানি-রপ্তানি সক্ষমতা বৃদ্ধি – পোশাক, সিমেন্ট, সার ও খাদ্যশস্য আমদানি-রপ্তানিতে খরচ কমে আসবে।
- বিদেশি জাহাজের উপর নির্ভরতা হ্রাস – নিজস্ব বহরের মাধ্যমে ফ্রেইট চার্জের বিপুল অর্থ দেশের বাইরে যাওয়া রোধ করা যাবে।
- জ্বালানি ও কাঁচামাল পরিবহন – বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পখাতে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল দ্রুত আনা-নেওয়া সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন বর্তমানে আন্তর্জাতিক রুটে একাধিক জাহাজ পরিচালনা করছে। তবে বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে সাথে নতুন, অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন ও জ্বালানি-সাশ্রয়ী জাহাজের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
জ্বালানি খাতে নতুন সিদ্ধান্ত — স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি
একই বৈঠকে দেশের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে দুই কার্গো এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানিরও অনুমোদন দেয়া হয়। এই এলএনজি আসবে সিঙ্গাপুর থেকে এবং এর জন্য ব্যয় হবে প্রায় ৯৮৭ কোটি টাকা।
কেন স্পট মার্কেট থেকে আমদানি
এলএনজি আমদানিতে সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি থাকে। তবে যখন তাৎক্ষণিক চাহিদা বেড়ে যায় বা বৈশ্বিক দামে সুবিধা পাওয়া যায়, তখন স্পট মার্কেট থেকে দ্রুত আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বাংলাদেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্পকারখানা ও গৃহস্থালি পর্যায়ে গ্যাসের চাহিদা গত কয়েক মাসে বেড়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বজায় রাখা এবং শিল্প খাতে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করতে এই তাৎক্ষণিক আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সমুদ্রপথে বাংলাদেশের অগ্রগতি
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক করিডর তৈরি করেছে। বঙ্গোপসাগর দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রুট গিয়েছে, যা বাংলাদেশকে একটি লজিস্টিক হাবে পরিণত করার সম্ভাবনা তৈরি করছে।
সরকারের পদক্ষেপ
- নিজস্ব বহর বৃদ্ধি: বিদেশি জাহাজ ভাড়া না করে নিজস্ব জাহাজে পরিবহন করে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়।
- আধুনিকীকরণ: পুরোনো জাহাজের পরিবর্তে জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব জাহাজ কেনা।
- বন্দর উন্নয়ন: চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন, যাতে বড় জাহাজ নোঙর করতে পারে।
অর্থনৈতিক প্রভাব
দুইটি নতুন বাল্ক ক্যারিয়ার যুক্ত হলে:
- বছরে শত কোটি টাকা ফ্রেইট চার্জ সাশ্রয় হবে।
- বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছাতে সময় কম লাগবে।
- আমদানিকৃত কাঁচামাল দ্রুত পৌঁছানোর ফলে শিল্প উৎপাদন বাধাহীন থাকবে।
এছাড়া, এলএনজি আমদানি দেশের বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক হবে, যা শিল্প ও বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
বাংলাদেশ মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৌপরিবহন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, “নিজস্ব বহর বৃদ্ধি করা শুধু অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সংকটকালীন সময়ে বিদেশি জাহাজের উপর নির্ভরশীলতা দেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।”
জ্বালানি খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, “স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা খরচসাপেক্ষ হতে পারে, তবে এটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য জরুরি।”
বাংলাদেশ সরকারের এই দুটি বড় সিদ্ধান্ত—যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৯৩৫ কোটি টাকায় দুই বাল্ক ক্যারিয়ার ক্রয় এবং সিঙ্গাপুর থেকে ৯৮৭ কোটি টাকায় দুই কার্গো এলএনজি আমদানি—দীর্ঘমেয়াদে দেশের বাণিজ্য ও জ্বালানি খাতকে শক্তিশালী করবে।
বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতা ও জ্বালানি সংকটের প্রেক্ষাপটে এই বিনিয়োগ বাংলাদেশের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
MAH – 12275 , Signalbd.com