পিডিবির অবহেলায় ২৪৫ কোটি টাকা জরিমানা

বাংলাদেশকে ২৪৫ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হলো পিডিবির ভুল সিদ্ধান্তের কারণে
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)-র এক ভয়াবহ ভুলের কারণে বাংলাদেশকে গুণতে হয়েছে বিশাল এক আর্থিক জরিমানা। ২০০০ সালের একটি আইসিসি (ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স) আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে পিডিবির অবহেলার কারণে ২৪৫ কোটি টাকা জরিমানা প্রদান করতে বাধ্য হয়েছে দেশ।
কী হয়েছিল ঘটনাটি?
১৯৯৭ সালে বেসরকারি খাতে হরিপুরে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে পিডিবির দুটি চুক্তি হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়সীমায় বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে ব্যর্থ হয় কোম্পানিটি। সরকারের দেয়া সময়সীমা শেষে কাজ না হলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে শর্ত থাকলেও, কোম্পানিটি কোনো কাজই শুরু করতে পারেনি। ফলস্বরূপ, পিডিবি ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে চুক্তি বাতিল করে এবং ১৫ লাখ ডলার ব্যাংক নিশ্চয়তা গ্রহণ করে।
কিন্তু, পিডিবি আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে মামলায় অংশগ্রহণ না করায় একতরফা রায় তাদের বিরুদ্ধে যায়। আইসিসির নির্ধারিত খরচ বাবদ মাত্র ৬০ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করতে পারলে হয়তো বাংলাদেশ বাঁচতে পারত এই অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে।
আইসিসির রায় ও তার প্রভাব
আইসিসির আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে অংশগ্রহণ না করায় ২০০৩ সালে একতরফা রায় পিডিবির বিরুদ্ধে আসে। এই রায়ে কোম্পানির দাবিকৃত ১ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ সহ সুদ বাবদ অর্থ প্রদান করতে হয়। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, এবং বাংলাদেশের আদালতে মামলাগুলো চালানো হয়।
অবশেষে ২০২৪ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত পিডিবির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রায় দেন, যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলার। এই অর্থ আজকের বিনিময়ে প্রায় ২৪৫ কোটি টাকা।
পিডিবির ভুল সিদ্ধান্তের কারণ ও পরিণতি
আইসিসির আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পিডিবির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ। তাদের আইনজীবীরা পরামর্শ দিয়েছিলেন, যেহেতু দেশের আরবিট্রেশন আইন তখনো (২০০১ সাল) প্রযোজ্য হয়নি, তাই বিদেশি আরবিট্রেশন রায়ের প্রভাব কম থাকবে। এই ভুল ধারণা ও অবহেলার কারণেই এককভাবে রায় বাংলাদেশের বিপক্ষে আসে।
বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, “আইনজীবী ও পিডিবির তৎকালীন পর্ষদের অবহেলা এবং ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আজ বাংলাদেশকে বিশাল অর্থ গুনতে হচ্ছে।”
অর্থ বিভাগের তথ্য মতে, পিডিবি নিজেই তাদের তহবিল থেকে ২৪৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে এবং এই টাকা যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ কো-জেনারেশন কোম্পানিকে প্রদান করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ঘটে যাওয়া জটিলতা
২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এবং অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। এসময় তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাসের বাসভবনে আশ্রয় নেন। স্মিথ কো-জেনারেশন তাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো চালিয়ে যায়।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মধ্যস্থতা করে বিষয়টি নিষ্পত্তির পথ খোঁজা হয়। ২০২৪ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ও আইনি প্রতিনিধিরা স্মিথ কো-জেনারেশনের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। এ আলোচনায় প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ২ কোটি ডলার জরিমানা দিতে সম্মত হয়।
তদন্তের অভাব ও দায়ী কারা?
বিদ্যুৎ বিভাগ ও অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এখনও পর্যন্ত এ ঘটনার দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিদ্যুৎসচিবও দায়ী ব্যক্তিদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যক্তিদের শনাক্ত করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।”
পিডিবির ইতিহাস ও নেতৃত্ব
১৯৯৬ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত পিডিবির বিভিন্ন চেয়ারম্যানদের মধ্যে নুরউদ্দিন মাহমুদ কামাল, কামরুল ইসলাম সিদ্দিক ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ মালেক ছিলেন, যাদের মধ্যে অনেকেই ইতিমধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছেন।
শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
ঘটনা থেকে শেখার বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক আইনি মঞ্চে অংশগ্রহণ ও সতর্কতার বিকল্প নেই। অংশগ্রহণ না করলে দেশের ওপর বড় ধরনের আর্থিক ও নৈতিক ক্ষতি হতে পারে। পিডিবির ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তির প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিতে হবে।
সার্বিক পর্যালোচনা ও প্রস্তাবনা
বাংলাদেশ সরকারের উচিত এমন একটি স্বচ্ছ ও গভীর তদন্ত পরিচালনা করা, যাতে দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানগুলো শনাক্ত হয়। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
সাত বছরের বেশি সময় ধরে চলা মামলাগুলো আমাদের শিক্ষা দেয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রে দেশের সুনাম ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা রক্ষায় প্রয়োজন যথাযথ নীতি ও আইনি প্রস্তুতি।
MAH – 12071, Signalbd.com