কর্মসংস্থান

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লোকবল সংকট, প্রশাসনিক গতি হচ্ছে ব্যাহত

বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঙ্গ—স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বর্তমানে মারাত্মক লোকবল সংকটে ভুগছে। জননিরাপত্তা এবং সুরক্ষা সেবা বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন অধিদপ্তরে বিপুল সংখ্যক পদ শূন্য থাকায় দাপ্তরিক কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে দাপ্তরিক গতি কমে গেছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপর চাপ বেড়েছে এবং জনগণের সেবার মানও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

দুই বিভাগের ১৬৫ পদ শূন্য, অধিদপ্তরে ৬ হাজারের বেশি শুন্যপদ

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুটি প্রধান বিভাগ—জননিরাপত্তা বিভাগসুরক্ষা সেবা বিভাগ—এ অনুমোদিত মোট ৫১৮টি পদের মধ্যে ১৪৬টি পদ শূন্য রয়েছে। এর বাইরে, অধিদপ্তর ও দপ্তরগুলোর শূন্যপদের সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়িয়ে গেছে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, সেবা ও নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

  • জননিরাপত্তা বিভাগে অনুমোদিত ২১৬টি পদের মধ্যে ৫৯টি শূন্য
  • সুরক্ষা সেবা বিভাগে ৩০২টি পদের মধ্যে ৮৭টি শূন্য

কারা, ফায়ার সার্ভিস ও পাসপোর্ট অফিসেও সংকট

সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীনে থাকা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অধিদপ্তরে শূন্যপদের চিত্র আরও উদ্বেগজনক।
কারা অধিদপ্তরে ১২,৭৬০টি অনুমোদিত পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ১,৭৮১টি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে ১৪,৫৭০ পদের মধ্যে ৯২৯টি খালি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে ৩,০৫৯টির মধ্যে ৮৮৪টি শূন্য এবং
বহির্গমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরে ১,৪৮০টি পদের মধ্যে ২৯৭টি শূন্য রয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাসিক সমন্বয় সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী (২১ মে), এই তথ্যগুলো সরাসরি উপস্থাপিত হয়েছে।

পুলিশ, বিজিবি ও আনসার বাহিনীতেও বিপুল শূন্যপদ

জননিরাপত্তা বিভাগের আওতাধীন বাংলাদেশ পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং কোস্ট গার্ড সহ বেশ কয়েকটি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে বহু পদ শূন্য রয়েছে:

  • নবম গ্রেড: ৯৯টি
  • দশম গ্রেড: ১,৭২২টি
  • একাদশ গ্রেড: ৪১টি
  • দ্বাদশ গ্রেড: ১৭টি
    মোট শূন্যপদ: ১,৮৭৯টি

বিশদভাবে দেখা যায়:

  • পুলিশ অধিদপ্তরে নবম গ্রেডের ১০৮টি পদের মধ্যে শূন্য ৭৯টি
  • দশম গ্রেডে ২২,০৫৩টির মধ্যে শূন্য ১,৪২৩টি
  • একাদশ গ্রেডে ৫৬টির মধ্যে ৩৭টি এবং
  • দ্বাদশ গ্রেডে ৪টির মধ্যে ৩টি শূন্য

বিজিবিতে ৫৭টি দশম গ্রেডের পদের মধ্যে ২৬টি শূন্য এবং দ্বাদশ গ্রেডে ৫০টির মধ্যে ১৪টি খালি।
আনসার বাহিনীর ৫৭৫টি দশম গ্রেডের পদের মধ্যে ২৫৫টি খালি।
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডে সাতটির মধ্যে চারটি দশম গ্রেডের পদ শূন্য।

বিভিন্ন শাখায় এক কর্মকর্তার একাধিক দায়িত্ব

জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক, পরিকল্পনা ও পুলিশ শাখাগুলোতেও পদসংকট প্রকট। উপসচিবদের অনেকেই একাধিক শাখার দায়িত্ব পালন করছেন। বিশেষ করে:

  • শৃঙ্খলা অধিশাখায় যুগ্ম সচিবের পদ ফাঁকা
  • একজন অতিরিক্ত সচিব তিনটি অধিশাখার দায়িত্বে: আইন ও শৃঙ্খলা, অর্থ ও প্রশাসন, এবং আনসার ও সীমান্ত শাখা

পাসপোর্ট অফিসগুলোতে চরম লোকবল সংকট

পাসপোর্ট ও বহির্গমন অধিদপ্তরের পরিস্থিতিও বেহাল। দিনাজপুর, কুমিল্লা, ফেনী ও সিলেটের মতো জেলাগুলোতে উপসহকারী পরিচালক ও অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর দিয়ে পুরো অফিস চালানো হচ্ছে।

সরকার পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া বাতিল করে সেবা সহজ করতে চাইলেও, অধিকাংশ জেলায় লোকবল না থাকায় তা বাস্তবায়নে হোচট খাচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন, জেলা পাসপোর্ট অফিসগুলোতে পদের সংখ্যা অন্তত পাঁচ গুণ বাড়ানো দরকার।

অতিরিক্ত কাজের চাপে মানসিক চাপ, পরিবারের ওপর প্রভাব

কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জানান, এখন একজন কর্মকর্তা দিনে ১০টির বদলে ৩০-৪০টি অফিসিয়াল চিঠি ড্রাফট করছেন। এতে কাজের মান যেমন খারাপ হচ্ছে, তেমনি মানসিকভাবে বিরক্ত হয়ে উঠছেন তাঁরা। এই ক্লান্তি ও উত্তেজনার প্রভাব পরিবারেও পড়ছে।

অন্যদিকে কর্মচারীরা বলছেন, দক্ষ অফিসারের অভাবে তাঁদের তিন-চার ঘণ্টা বেশি সময় অফিসে থাকতে হয়। অথচ অতিরিক্ত কাজের কোনো অতিরিক্ত বেতন দেওয়া হয় না।

মন্ত্রণালয়ের জবাব: পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ চাওয়া হয়েছে

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি আজকের পত্রিকাকে জানান, “লোকবল নিয়োগে সরকারি নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। অধিকাংশ পদ বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)-এর মাধ্যমে পূরণ করা হয়। আমরা বিভিন্ন দপ্তর থেকে পিএসসিতে চাহিদা পাঠিয়েছি। বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা শেষে ধাপে ধাপে নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণেও কিছু জায়গায় ধীরতা রয়েছে। আমরা গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দ্রুত পূরণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button