বাংলাদেশ

খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার শীর্ষ ৫ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ, জাতিসংঘের প্রতিবেদন

 জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থার যৌথ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চরম খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগা শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়লেও এখনো কোটি মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার অধরাই। বিশ্লেষকরা বলছেন, দৃশ্যমান ক্ষুধা নেই, কিন্তু চাপা ক্ষুধা ভয়াবহ বাস্তবতা।

দেশের অবস্থান চতুর্থ, আশঙ্কাজনক বাস্তবতা তুলে ধরছে নতুন রিপোর্ট

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO), ইফাদ, ডব্লিউএফপি, ইউনিসেফ ও ডব্লিউএইচও’র যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২৫’ অনুসারে, বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের পঞ্চম সর্বোচ্চ চরম খাদ্যনিরাপত্তাহীন দেশের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, নাইজেরিয়া, সুদান ও কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের পরে বাংলাদেশে রয়েছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ যারা প্রতিদিনের খাদ্যের মৌলিক নিরাপত্তা থেকেও বঞ্চিত।

এই তালিকায় বাংলাদেশের স্থান পাওয়া শুধু পরিসংখ্যানগত তথ্য নয়, বরং দেশের খাদ্যনীতির একটি বড় সংকেত।

খাদ্য উৎপাদন বাড়লেও পৌঁছায় না সবার কাছে

গত এক দশকে বাংলাদেশে ধান, গম, শাকসবজি, মাছ ও মাংস উৎপাদনে লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে। পাশাপাশি মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। কিন্তু খাদ্য উৎপাদনের এই প্রবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের খাবার টেবিল পর্যন্ত ঠিকমতো পৌঁছাতে পারছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনে কাঠামোগত দুর্বলতা, বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, বিতরণ ব্যবস্থার বৈষম্য এবং ক্রয়ক্ষমতার ঘাটতির কারণেই অনেক মানুষ আজও নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত।

৭ কোটি ৭০ লাখ মানুষ এখনো পায় না স্বাস্থ্যসম্মত খাবার

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৪৪ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ ৭ কোটি ৭০ লাখের বেশি মানুষ এখনো প্রতিদিনের স্বাস্থ্যসম্মত ও সুষম খাবারের নাগাল পায় না।
যদিও ২০১৭ সালে এই অনুপাত ছিল ৬৫.৭ শতাংশ, তবুও এখনো প্রায় অর্ধেক জনগণ অপুষ্টির ঝুঁকিতে রয়েছে।

বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এখনো দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্বাস্থ্যকর খাবার না পাওয়া দেশের তালিকায়। এর চেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে শুধু পাকিস্তান।

শিশুর পুষ্টিহীনতা সংকেত দিচ্ছে ভবিষ্যতের বিপদ

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ১০ শতাংশের ওজন বয়স অনুযায়ী কম এবং ২৫ শতাংশ শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি যথাযথ নয় (খর্বকায়)।
অর্থাৎ ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও একটি বড় অংশ শারীরিক ও মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ভারতে যেখানে খর্বকায় শিশুর হার ৩৩ শতাংশ, পাকিস্তানে তা প্রায় ৩৭ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থানও খুব আশাব্যঞ্জক নয়।

চরম খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সংজ্ঞা ও বাংলাদেশ

জাতিসংঘের ভাষায়, ‘চরম খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা’ বলতে বোঝানো হয়—যখন কোনো ব্যক্তি বা পরিবার আর্থিক অথবা অন্যান্য কারণে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণে অক্ষম হয়ে পড়ে।
এই অবস্থায় তাদের জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো ব্যাহত হয় এবং অপুষ্টি, রোগপ্রবণতা ও আয়ু হ্রাসের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়।

বাংলাদেশে এমন চরম পরিস্থিতিতে থাকা মানুষের সংখ্যা প্রতিবছরই উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।

সরকারের অবস্থান ও বিতর্ক

সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের খাদ্য মজুত যথেষ্ট রয়েছে এবং জাতিসংঘের প্রতিবেদনের ব্যাখ্যা নিয়ে তারা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে।
খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ) এর মহাপরিচালক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, “আমাদের খাদ্য মজুত ভালো। হতে পারে, খাদ্য আছে কিন্তু সবার কাছে পৌঁছায় না। স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যে প্রবেশাধিকারের সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে।”

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি আত্মতুষ্টির সময় নয়। খাদ্য সরবরাহে বৈষম্য, পুষ্টির দিক থেকে খাদ্যের মান এবং দাম সাধারণ মানুষের নাগালে আনতে না পারলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।

অর্থনীতিবিদদের মত: দৃশ্যমান না হলেও চাপা ক্ষুধা ভয়ঙ্কর

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, “সরকার সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে প্রাধান্য দিচ্ছে, কিন্তু ব্যক্তিপর্যায়ে মানুষের যে সংকট, তা উপেক্ষিত। দেশে দৃশ্যমান ক্ষুধা হয়তো নেই, কিন্তু চাপা ক্ষুধা আছে। মানুষ স্বেচ্ছায় কৃচ্ছ্রসাধনে বাধ্য হচ্ছে।”

এই ‘চাপা ক্ষুধা’কে অনেকেই বলেন ‘অদৃশ্য ক্ষুধা’। মানুষ হয়তো তিনবেলা খাচ্ছে, কিন্তু পুষ্টির অভাবে দেহ ও মনের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটছে না।

কীভাবে মুক্তি মিলবে এই সংকট থেকে?

বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধি নিশ্চয় ইতিবাচক দিক, কিন্তু তা যে সকলের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করেনি, তা স্পষ্ট।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বিস্তার, দরিদ্র জনগণের জন্য খাদ্য সহায়তা, মূল্যনিয়ন্ত্রণ এবং খাদ্য বণ্টনের সুষ্ঠু ব্যবস্থার দিকেই এখন নজর দিতে হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, “নিরাপদ খাদ্যের অভিগম্যতা নিশ্চিত না হলে উন্নয়ন হবে কেবল পরিসংখ্যানের মধ্যে। বাস্তবে মানুষ থাকবে ঝুঁকির মুখে।”

এম আর এম – ০৬৯০, Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button