শ্রমিক স্বাস্থ্য-আবাসনে সুপারিশ, একক শ্রম আইন আসছে

শ্রমজীবী মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও আবাসনের নিশ্চয়তার জন্য বড় ধরনের সুপারিশ নিয়ে এসেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। শ্রমিকদের জন্য ‘শ্রমিক স্বাস্থ্য কার্ড’ চালু, শিল্পাঞ্চলে হাসপাতাল স্থাপন, স্বল্পসুদে গৃহঋণ সুবিধা এবং ‘শ্রমিক আবাসন তহবিল’ গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উঠে এসেছে কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সম্প্রতি ১৮ সদস্যবিশিষ্ট শ্রম সংস্কার কমিশন তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। ‘শ্রম জগতের রূপান্তর-রূপরেখা: শ্রমিক অধিকার, সুসমন্বিত শিল্প সম্পর্ক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে মোট ২৫টি সুপারিশ রয়েছে।
শ্রমিক স্বাস্থ্য কার্ড ও চিকিৎসা সুবিধার সুপারিশ
কমিশন সুপারিশ করেছে, শ্রমিকদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্য কার্ড চালু করতে হবে, যাতে তাদের চিকিৎসা ইতিহাস সংরক্ষণের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবায় অগ্রাধিকার পাওয়া যায়। প্রতিটি শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট হাসপাতাল স্থাপনের প্রস্তাব রয়েছে, যেখানে সন্ধ্যাকালীন সেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দিতে হবে।
এছাড়া ২৪ ঘণ্টা টোল-ফ্রি টেলিমেডিসিন সেবা চালুর পাশাপাশি কমমূল্যের স্বাস্থ্যবিমা প্যাকেজ চালু করারও সুপারিশ করেছে কমিশন। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে শ্রমিকরা ন্যূনতম ব্যয়ে মানসম্পন্ন চিকিৎসা পেতে সক্ষম হবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শ্রমিকদের জন্য আবাসন তহবিল ও সাশ্রয়ী গৃহঋণ
শ্রমিকদের বাসস্থান সংকট দীর্ঘদিনের সমস্যা। এই বাস্তবতা বিবেচনায় শ্রম সংস্কার কমিশন ‘শ্রমিক আবাসন তহবিল’ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া স্বল্পসুদে গৃহঋণ সুবিধা চালুর জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণ বিতরণে উৎসাহ দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
কমিশনের মতে, শিল্পমালিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে প্রণোদনামূলক নীতিমালা তৈরি করা জরুরি। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে শ্রমঘন এলাকায় সাশ্রয়ী আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নও কমিশনের অগ্রাধিকার সুপারিশের মধ্যে রয়েছে।
একক শ্রম আইন ও শিশুশ্রম নিরসনে সুপারিশ
বর্তমানে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) ও অন্যান্য শিল্প অঞ্চলের জন্য পৃথক শ্রম আইন কার্যকর। কমিশন বলেছে, একটি একক ও সমন্বিত শ্রম আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন, যাতে সব শ্রমিক সমভাবে আইনি সুরক্ষা পান।
শিশুশ্রম নিরসনে ২০৩০ সালের মধ্যে কর্মে নিয়োজিত হওয়ার ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর নির্ধারণের প্রস্তাব এসেছে। ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোরদের জন্য বিশেষ ধরনের কাজের সুযোগ নিশ্চিতের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা ও সৃজনশীলতা বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।
ডে-কেয়ার ও নারী শ্রমিকদের সুবিধা
নারী শ্রমিকদের সহায়তায় প্রতিটি শিল্পাঞ্চল ও বড় কারখানাগুলোর পাশে ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপনের সুপারিশ করেছে কমিশন। এ উদ্যোগের মাধ্যমে কর্মরত মায়েরা শিশুদের সঠিক যত্ন নিশ্চিত করতে পারবেন।
এছাড়া মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস নির্ধারণের পাশাপাশি যৌথ উদ্যোগে কমিউনিটি ডে-কেয়ার পরিচালনার জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ চারটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে কাঠামো তৈরির প্রস্তাবও রয়েছে।
মজুরি ও ক্ষতিপূরণ কাঠামোয় সংস্কার
শ্রমিকদের মজুরি ন্যায্যভাবে নির্ধারণে তিন বছর পরপর মজুরি মূল্যায়নের প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন। একই সঙ্গে বছরে একবার মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে মজুরি বৃদ্ধির ব্যবস্থা চালুরও সুপারিশ করা হয়েছে।
বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ দুই লাখ টাকা। এটিকে অপ্রতুল উল্লেখ করে কমিশন সর্বনিম্ন ক্ষতিপূরণ সীমা বাড়ানোর পাশাপাশি, দুই বছরের চাকরির শর্ত কমিয়ে এক বছরে আনার পরামর্শ দিয়েছে।
চাকরি যেভাবেই শেষ হোক না কেন, প্রত্যেক শ্রমিককে গ্র্যাচুইটি ও অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার আইনগত নিশ্চয়তা দিতে হবে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
রাইড শেয়ার চালকদের শ্রমিক স্বীকৃতি
ডিজিটাল যুগে রাইড শেয়ারিং চালকরা শ্রমবাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। কমিশনের প্রতিবেদনে তাদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সুরক্ষা, ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া কোম্পানিগুলোর কমিশন হার যৌক্তিকভাবে কমানো, চালকদের অ্যাকাউন্ট বন্ধে স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং বিশেষ মজুরি কাঠামো নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরা হয়েছে।
কমিশনের প্রধানের ব্যাখ্যা
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, “আমরা কোনো অবাস্তব সুপারিশ করিনি। সব শ্রমিকের জন্য ন্যূনতম সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করেছি।” তিনি আরও জানান, “প্রাথমিকভাবে কোন সুপারিশগুলো বাস্তবায়নযোগ্য, কোন মন্ত্রণালয় কীভাবে এগুলো কার্যকর করতে পারে, তার একটি রূপরেখা দেওয়া হবে। সেই রূপরেখায় বর্তমান সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারেও প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব থাকবে।”